ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

প্রতি বছর বন্যাকবলিত বাংলাদেশ, নিষ্পত্তি কোথায়

আয়মান রেহমান জাহিদ

প্রকাশিত: ২০:০৪, ১৬ জুন ২০২৫

প্রতি বছর বন্যাকবলিত বাংলাদেশ, নিষ্পত্তি কোথায়

বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির লীলাভূমি। অথচ প্রতি বছর এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এই ভূখণ্ড। আর তা হলো বন্যা। বর্ষাকাল এলেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের অনেক জেলায় শুরু হয় পানির দাপট। কখনও তা ধীরে ধীরে আসে, কখনো আকস্মিকভাবে। কখনো নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ডুবে যায় গ্রাম-শহর। আবার কখনো পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ভেসে যায় ফসল, ঘর-বাড়ি, জীবিকা। এই চক্র যেন অনন্ত। প্রশ্ন জাগে- এই দুর্ভোগের নিষ্পত্তি কোথায়?
বন্যা নিঃসন্দেহে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু আধুনিককালে এটির পুনরাবৃত্তি ও ভয়াবহতা যে মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড দ্বারা আরও প্রকট হয়ে উঠছে, তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন এক জটিলতার মাঝে যে এটি তিনটি প্রধান নদীর (পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র) মোহনায় অবস্থিত। এই নদীগুলোর জলধারা আসে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে এবং পুরো উপমহাদেশ পেরিয়ে এদেশে এসে মিলিত হয়। ফলে শুধু বাংলাদেশের বৃষ্টিপাত নয়, ভারত ও নেপালের উজানে বৃষ্টি হলেও বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়ে। এছাড়াও আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদী ভরাট, বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রোধ করা, অপরিকল্পিত চাষাবাদ, বন উজাড়, জলাভূমি ভরাট এসব মিলিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে।
প্রতি বছর যখন বন্যা আসে, তখন ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটা কেবল জমি বা সম্পদেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং এর গভীরতা আরও অনেক বিস্তৃত। বন্যার সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষিজমি। ধান, পাট, শাক-সবজি পানিতে তলিয়ে গিয়ে কৃষকের বছরের পর বছরের শ্রম হারিয়ে যায়। ফলে খাদ্যের উৎপাদন কমে যায়, যার প্রভাব পড়ে সারাদেশে খাদ্যদামের ওপর।
নিম্ন ভূমিতে বসবাসরত মানুষ দিন কাটান অনেকটাই ভয়ে। প্রতি বছরই বন্যায় বাড়ি হারিয়ে তাদেরকে হতে হয় আশ্রয়হীন। হাজার হাজার পরিবারকে স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা রাস্তার পাশে আশ্রয় নিতে হয়। শিশু, বৃদ্ধ ও নারীরা হয় সবচেয়ে বেশি বিপন্ন। দূষিত পানিতে পানিবাহিত রোগের বিস্তার ঘটে। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগের মতো অসুখে মানুষ ভোগেন। অথচ তখন সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও হয় না। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় স্কুল-কলেজ। বন্যা-পরবর্তী সময়েও দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকে। শিশুদের পড়াশোনায় তৈরি হয় দীর্ঘ ছেদ। দেশীয় অর্থনীতি, বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতি বন্যায় বিপর্যস্ত হয়। গরু-মহিষ মারা যায়, দোকানপাট ভেসে যায়, রাস্তা-ঘাট নষ্ট হয়, ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে।
২০২৪ সালের, মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রেমাল বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। ফলে ৪.৬ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুর্যোগে ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে এবং ১.৩ মিলিয়ন মানুষ মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। জুন মাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে হাওর অঞ্চল প্লাবিত হয়। এই বন্যায় প্রায় ২.১ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৩০,০০০ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে হয়। আগস্ট মাসে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে পানি ছাড়ার ফলে বাংলাদেশের ১১টি জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। এই বন্যায় ৫.৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৫০ জনের বেশি প্রাণ হারায়। প্রায় ৫ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। অক্টোবর মাসে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে বাংলাদেশের শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলায় বন্যা দেখা দেয়। এই বন্যায় ৬০,০০০ পরিবার বাস্তুচ্যুত হয় এবং ১১ জনের মৃত্যু ঘটে। প্রায় ৯২,০০০ হেক্টর কৃষিজমি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২৪ সালের বন্যাগুলোর ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪,৪২১.৫ কোটি টাকা (প্রায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) হয়েছে, যা ২০২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১.৮ শতাংশের সমান। এছাড়া, বন্যায় প্রায় ১.১ মিলিয়ন টন চাল ধ্বংস হয়েছে, যার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
বন্যা বাংলাদেশে থাকবে, এটা মেনে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি ‘সহনশীলতা’তৈরি করছি? আমরা কি বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? না কি তাকে মোকাবেলার শক্তি অর্জন করাই শ্রেয়? ভারত, নেপাল এবং চীনের সঙ্গে ট্রান্সবাউন্ডারি ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আমাদের আরও জোরালো কূটনীতি গড়ে তুলতে হবে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব, উজানে বাঁধ নির্মাণ, পানি ছাড়া-নির্বন্ধ এসব ইস্যুতে তথ্য ভাগাভাগি ও সমন্বয় প্রয়োজন। দখলদারদের হাত থেকে নদী উদ্ধার করতে হবে। নদী খনন করতে হবে, এবং তার পাড়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হবে। নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ। আধুনিক স্যাটেলাইট ও ড্রোন প্রযুক্তি, রাডার ও পূর্বাভাসব্যবস্থা ব্যবহার করে আমরা অনেক আগে থেকেই মানুষকে সতর্ক করতে পারি। ভারতের IMD এবং বাংলাদেশের IMD একত্রে কাজ করলে পূর্বাভাস আরও নির্ভুল হতে পারে।
বন্যা প্রবণ এলাকায় এমন অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা উঁচু ভিত্তির উপর হবে, ও পানির নিচেও কিছুটা টিকে থাকতে পারবে। তেমন আশ্রয়কেন্দ্র বাড়াতে হবে, যেখানে নারী-শিশুদের আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। বন্যা সহিষ্ণু ধান ও ফসল চাষের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, বন্যা সহনশীল ধানের জাত (BRRI dhan51, 52, 93) বেশ কার্যকর। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের এসব চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, সেচ কমিটি, কৃষক সমবায়, NGO এবং স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে বন্যা ব্যবস্থাপনার স্থানীয় কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। রাজধানী থেকে নির্দেশনা দিলেই সমস্যার সমাধান হয় না। সত্য হলো, আমরা এখনো দুর্যোগ প্রতিক্রিয়াতে বেশি গুরুত্ব দিই, প্রস্তুতির চেয়ে। অর্থাৎ যখন বন্যা হয়, তখন ত্রাণ নিয়ে ছুটে যা। কিন্তু বন্যা না হবার সময়েও প্রস্তুতি নেই, পরিকল্পনা নেই, স্বচ্ছ কৌশল নেই। আরও গভীরভাবে বললে, বন্যা একটি রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের আগে বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু কাজ হয় না। অনেকে বাঁধের কাজের অর্থ আত্মসাৎ করে। ফলে পরের বছর আরও বড় ক্ষতির মুখে পড়ে মানুষ।
এদেশে যদি আমরা সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন চাই, তাহলে বন্যাকে দুর্যোগ নয়, বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সেই বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে আমাদের পরিকল্পনা, উন্নয়ন, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থাকে। জাতীয় পর্যায়ে যেমন নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব আছে, তেমনি সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরাও পরিবর্তনের অংশ হতে পারি। নদী দখল-দূষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে, বন্যার সময় স্বেচ্ছাসেবক হতে হবে, ফসল রক্ষা বাঁধে নজরদারি করতে হবে।
প্রতি বছর একই দৃশ্য, একই কান্না, একই ক্ষয়ক্ষতি। তবুও নিষ্পত্তির প্রশ্নে আমরা যেন চুপচাপ! আর কতকাল? এখন সময় ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন, মানসিকতার পরিবর্তন, আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। বন্যা আমরা ঠেকাতে পারি না, তবে ক্ষতি কমাতে পারি। বন্যা কবলিত মানুষের পাশে সবাই মিলে দাড়াতে পারি এবং সেই কাজ এখনই শুরু করতে হবে। কারণ পানি বয়ে যায়, কিন্তু ক্ষত থেকে যায় দীর্ঘদিন।

লেখক :  শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

প্যানেল

×