ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল, মাসে আয় ৫০ হাজার

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ০১:০১, ১৭ জুন ২০২৫

শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল, মাসে আয় ৫০ হাজার

শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ সম্পূর্ণ অচল। দাঁড়ানো তো দূরের কথা, ঠিকমতো বসতেও পারেন না। অন্যের সহায়তা ছাড়া চলাচল সম্ভব নয়। হাত দুটোও প্রায় অচল। তবুও জীবনযুদ্ধে হার মানেননি ২৩ বছর বয়সী গোলাম রাব্বানী। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী; কখনও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি, স্কুলের গন্ডি পর্যন্ত পা দেওয়া হয়নি। তবু নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর দৃঢ়চেতা মানসিকতায় নিজেকে গড়ে তুলেছেন সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। বর্তমানে মাসে গড়ে আয় করছেন ৫০ হাজার টাকা। পাঁচ সদস্যের সংসারের হাল ধরছেন এই তরুণ।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভার চিঙ্গুরিয়া এলাকায় এক জীর্ণ ঘরে বসবাস করেন গোলাম রাব্বানী। ২০২১ সাল পর্যন্ত নিজেকে অর্থহীন মনে করতেন এই চলনশক্তিহীন যুবক। জীবনকে বোঝা মনে করতেন, ভাবতেন সারাটা জীবন বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে কাটবে। কিন্তু এক সময় নিজেকে নিয়ে কিছু করার দৃঢ় সংকল্প নেন। ১৯ মাসে নিজেই কোরআনের হাফেজ হয়েছেন। এরপর ফ্রিল্যান্সিংয়ের স্বপ্ন নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন।

আড়াই হাজার টাকার একটি পুরনো এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ক্রয় করে অনলাইন কাজ শুরু করেন। বাংলা-ইংরেজি অক্ষর চিনতে না পারলেও ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে ফ্রিল্যান্সিং শিখে নিজেকে গড়ে তোলেন। একের পর এক অনলাইন কোর্স শেষ করে দক্ষতা অর্জন করেন। ২০২১ সালের জুনে প্রথম মাসে মাত্র ১০০ টাকা আয় থেকে শুরু করে পরের মাসে আয় ১৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠে।

পরে লোন নিয়ে একটি কম্পিউটার কিনে দিনরাত ১০-১৫ ঘণ্টা পরিশ্রম করে সফলতা পেতে থাকেন। পরবর্তীতে ল্যাপটপও কিনেছেন, যদিও সেটা নষ্ট হয়ে যায়। ২০২৪ সালে এক ক্লায়েন্টের সহযোগিতায় আধুনিক প্রযুক্তি ও হুইলচেয়ার ক্রয় করেন, যা ব্যাটারিচালিত।

গোলাম রাব্বানী বলেন, গোসল-ওয়াশরুমের কাজ বাবার সহায়তায় করতে হয়। বাবাও অসুস্থ ও বেকার। বড় বোন সুইটি আক্তারও শারীরিক প্রতিবন্ধী, আর ছোট বোন আফসানা (১০) স্বাভাবিক। তবে পুরো পরিবার যেন প্রতিকূলতার স্রোতে ভাসমান। লড়াইয়ের প্রধান যোদ্ধা রাব্বানী নিজেই।

তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম্মাননাও পেয়েছেন। আয় দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ঋণ শোধ করেছেন। ঘরের একটি কাঠের চৌকির পাশে একটি তক্তায় কম্পিউটার সরঞ্জাম রেখে দিন-রাত কাজ করেন। মনিটর একটি নষ্ট হয়ে গেছে।

রাব্বানীর জীবনযুদ্ধ থেকে শেখার আছে অনেক। তিনি অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন সমাজের অন্যান্য হতাশ মানুষদের কাছে। তিনি বলেন, “কিছু করার ইচ্ছা থাকলেই পারা যায়, এটা ভুলেও ভেবে নয়।”

তার এখন সবচেয়ে প্রয়োজন একটি নিরাপদ বসতঘর, স্বাস্থ্যসম্মত রুম, যেখানে বসার উপযোগী চেয়ার এবং ফ্রিল্যান্সিং কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সুষ্ঠুভাবে থাকবে।

রব্বানী আরো জানান, সরকারি সহায়তার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সমাজসেবা অফিসে গিয়েও সঠিক সহযোগিতা পাননি। তবে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন।

মা আখিনুর বেগম বলেন, “আমার ছেলে পড়াশোনা করেনি, সম্পূর্ণ অচল, কিন্তু এখন আয় করছে। এটা ভেবে আমি গর্বিত। তবে কাজের পরিবেশ নিয়ে আমি সবসময় উদ্বিগ্ন থাকি।”

দৃষ্টান্তস্থাপক এই প্রতিবন্ধী যুবকের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন তার কর্মস্থলের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা এবং যথাযথ সহায়তা প্রদান।

শেখ ফরিদ

×