ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

অপরিকল্পিত নগরায়নে বিলীন হচ্ছে কৃষি জমি

ওসমান গনি

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ১৬ জুন ২০২৫

অপরিকল্পিত নগরায়নে বিলীন হচ্ছে কৃষি জমি

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র। আবহমানকাল ধরে এ দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা কৃষিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা, খাদ্য ও পুষ্টির প্রধান উৎস কৃষি। অথচ, অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আধুনিকায়ন ও নগরায়নের ঢেউয়ে আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে আমাদের এই কৃষি ব্যবস্থার মূলভিত্তি ফসলি জমি। অপরিকল্পিত নগরায়ন যেন এক মরণছায়ার মতো গ্রাস করে নিচ্ছে দেশের উর্বর কৃষিজমিগুলোকে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ‘নগরায়নের নামে উন্নয়ন’ এখন একপ্রকার ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। যেখানে একদিকে গড়ে উঠছে সুউচ্চ ভবন, বিশাল বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স, আধুনিক শিল্পাঞ্চল। অন্যদিকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত একর জমির ওপর গড়ে ওঠা চাষাবাদ, গ্রামীণ জীবন ও খাদ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য বলছে, বিগত দুই দশকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BBS) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর কৃষি জমি হারিয়েছে বাংলাদেশ। এসব জমি গেছে শিল্প স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বেসরকারি আবাসন, সরকারি স্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, এমনকি অবৈধ দখলের কবলে পড়ে। রাজধানী ঢাকার চারপাশে গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বহু ফসলি জমিতে ইট, বালু ও সিমেন্টের পাহাড় গড়ে উঠেছে। বিশাল বিশাল হাউজিং প্রকল্প, যেখানে একসময় ধান, পাট বা সবজির খেত ছিল, এখন সেখানে বহুতল ভবন, শপিং মল, রাস্তাঘাট। নগরায়নের এই প্রবণতা শুধু ঢাকাতে সীমাবদ্ধ নয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশালসহ দেশের প্রায় সব শহরই এর কবলে পড়েছে। এখন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে একটি সময়ের ধানক্ষেত এখন একটি বহুতল ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পায়ের নিচে কংক্রিট হয়ে গেছে। অথচ, সেই জমির ফসল এক সময় কয়েকশো মানুষের খাবার যোগাতো।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নগর সম্প্রসারণ হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। কোন এলাকায় শিল্প হবে, কোন এলাকায় আবাসন গড়বে আর কোন এলাকাকে কৃষি উপযোগী রাখা হবে এমন একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যানের অভাব সর্বত্র। যদিও কিছু কিছু শহরে মহাপরিকল্পনা (Master Plan) তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে গতি নেই। ভূমি সংক্রান্ত আইন থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ খুব দুর্বল। ২০১১ সালে গৃহীত ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার নীতিমালা’ অনুসারে কৃষি জমি যাতে অকৃষি খাতে ব্যবহার না হয়, তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এ নীতিমালার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ভূমি দালাল ও হাউজিং কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে অনেক কৃষক জমি বিক্রি করে ফেলছেন। জমির চেয়ে তাৎক্ষণিক টাকাকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। এর পেছনে দারিদ্র্য, সচেতনতার অভাব ও কৃষির প্রতি তরুণ প্রজন্মের অনাগ্রহ ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১১ কোটিতে পৌঁছাতে পারে। এই চাপ সামলাতে গেলে যদি পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে নগর সম্প্রসারণের একমাত্র লক্ষ্য হবে আশপাশের কৃষি জমি দখল।
কৃষি জমি হারানোর অর্থ শুধু খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়া নয়। এটি একটি পরিবেশগত বিপর্যয়ও। ফসলি জমি পানি ধরে রাখে, মাটির উর্বরতা বজায় রাখে এবং স্থানীয় জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে রাখে। কিন্তু কংক্রিট, পিচ ও ইট-বালুর দখলে গেলে সেই ভূমি আর কখনোই জীবন্ত থাকে না। এছাড়া কৃষি জমি হারিয়ে মানুষ যখন কৃষি থেকে সরে আসে, তখন তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে গ্রামীণ দারিদ্র্য বাড়ে, শহরের ওপর চাপ বাড়ে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করে থাকে। যদি কৃষি জমি হারানোর হার একইভাবে চলতে থাকে, তবে ২০৪০ সালের মধ্যে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে এবং দুর্যোগকালীন সময়ে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। যুদ্ধ, জলবায়ু বিপর্যয় বা বৈশ্বিক মন্দার সময় খাদ্য আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
তাই প্রথমেই দরকার, একটি যুগোপযোগী ‘জাতীয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন। কৃষি জমি, আবাসন, শিল্প, বন ও জলাশয়ের জন্য নির্ধারিত জোন নিশ্চিত করতে হবে। এই পরিকল্পনায় প্রাধান্য দিতে হবে কৃষিকে। কৃষি জমিকে শিল্প/আবাসিক কাজে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতির বিধান থাকতে হবে। কৃষি জমি ধ্বংসকারী হাউজিং প্রকল্পের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। নগরায়নের প্রয়োজন মেটাতে উঁচু ভবনের দিকে ঝুঁকতে হবে। এতে করে ভূমির ব্যবহার কম হবে এবং কৃষি জমি সংরক্ষণ সম্ভব হবে। কৃষকদের জমি বিক্রির প্রবণতা ঠেকাতে তাদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করতে হবে। প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ, ফসলের ন্যায্য মূল্য ও আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক করে তুলতে হবে। শুধু সরকার নয়, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি জমির গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে কৃষি ও ভূমি রক্ষার গুরুত্ব অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন কেবল একটি উন্নয়ন সংকট নয়, এটি একটি অস্তিত্ব সংকট। শহর গড়তে গিয়ে আমরা যদি মাটির শেকড় কেটে ফেলি, তবে একসময় শহরটিও টিকবে না। আমরা উন্নয়ন চাই। তবে তা যেন হয় সুপরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে বিবেচনায় রেখে। এই মুহূর্তে কৃষি জমি রক্ষা করাকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। একটি জাতি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হলে, তার উন্নয়ন টেকসই হয় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুখে খাবার তুলে দিতে হলে আজই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কী আরও একটি শপিং মল চাই, নাকি একটি উর্বর ক্ষেত? বাংলাদেশের উন্নয়ন জরুরি। তবে তা হতে হবে সুষম, পরিকল্পিত এবং কৃষিবান্ধব। কৃষি জমি কেবল খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র নয়, এটি গ্রামীণ জীবনের চালিকাশক্তি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এবং অর্থনীতির প্রাণ। একে ধ্বংস করে আমরা যে নগর গড়ছি, সেটি একদিন হয়তো খাদ্যহীন, পানিহীন, প্রাণহীন হয়ে উঠবে। পরিকল্পনাবিহীন নগরায়নের লাগাম এখনই টেনে না ধরলে, অদূর ভবিষ্যতে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। এখনই সময় কৃষি জমিকে ‘উন্নয়নের শিকার’ নয়, বরং উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিবেচনা করার।

লেখক : সাংবাদিক 
[email protected]

 

প্যানেল

×