ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

ঢাকার দিনরাত

মারুফ রায়হান

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৬ জুন ২০২৫

ঢাকার দিনরাত

চেনা ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে রাজধানী

আষাঢ়ের প্রথম দিনটি ছিল রবিবার। ঢাকাবাসীকে একেবারে হতাশ করেনি আষাঢ়, সকালের দিকে অল্প সময় বৃষ্টি হয়েছে মহানগরীর কোনো কোনো এলাকায়। আবার কোথাও ছিল ঝকঝকে রোদ।

১০ দিন ঈদের ছুটির পরে চেনা ছন্দে মহানগরী

ঈদ-পরবর্তী ঢাকার চিত্র তুলে ধরতে গেলে আমাদের অতীতমুখিতা পেয়ে বসতে পারে। আর তার সঙ্গে অবধারিতভাবে থাকবে পুনরাবৃত্তি। ফি বছর ঈদের পরে ঢাকার চেহারার তো তেমন বদল হয় না। বিশেষ করে কোরবানি ঈদের কথা বললে আমরা নিশ্চিতরূপেই বলতে পারি যে ঈদের পরে অন্তত একটি সপ্তাহ ঢাকা থাকে ছিমছাম, ফাঁকা আর কি যেন নেই কি করি কোথায় যাইÑ এমন একটি দশা। 
ঢাকা ছেড়ে যারা চলে যায় দেশের বাড়িতে ঈদ করতে তারা ফিরলেই সত্যিকারের ব্যস্ততা আর প্রাণ ফিরে আসে ঢাকা শহরের। ঈদের সময়ে, মানে অবকাশের দিনগুলোয় ঢাকাবাসীদের কিছু সাধারণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। থাকে বিড়ম্বনাও। প্রথমত ঘরের বাইরে বের হলে প্রত্যাশিত যানবাহন মেলে না। গণপরিবহনের সংখ্যাও কমে যায়। রিক্সা এবং সিএনজি অটোরিক্সা কোথাও কোথাও কম চলে। সেখানকার অধিবাসীরা পড়েন বিপাকে। রিক্সাওলারাও ঈদ করতে যায় দেশের বাড়ি। যা হোক, কোনো কোনো এলাকায় আবার কোনো যানবাহনেরই অভাব দেখা যায় না। বরং অভাব থাকে ঘরের বাইরে বেড়াতে বেরুনো মানুষজনের। দোকানপাট খুব কমই খোলে। 
কোরবানির মাংস সহযোগে ভাত বা পোলাও খাওয়ার পর অনেকেই দই খেতে পছন্দ করেন। ঈদের সময়টাতে এই দইয়ের কিছুটা অভাব দেখা দেয়। গুণগতমানের বিচারে এগিয়ে থাকা দামি মিষ্টির দোকানে দিনভরই দই আসতে থাকে ভ্যানে। ১০ থেকে ১২ বার দই সরবরাহ করার মাধ্যমে এলাকার দই ক্রেতাদের চাহিদা মেটানো লাগে। ওহ পাউরুটির কথা বলতে ভুলে গেছি। সেটিও ঈদের অবকাশে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে ওঠে।

তবে এবার কোরবানি ঈদে মানুষ ভুগেছে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে। নামকরা ব্যাংকের বুথগুলোতে গিয়ে গ্রাহকেরা নিয়মিতভাবেই আশাহত হয়েছেন। এটিএম কার্ড হচ্ছে যখন তখন টাকা তোলার যাদুর কাঠি। তা না মানলেও অন্তত ব্যাংক বন্ধ থাকলে টাকা তোলার শতভাগ নিশ্চয়তা থাকবে। এমনটি যারা ভাবেন তাদের তোয়াক্কাই করেনি এবার ঈদের ছুটিতে বহু ব্যাংকের এটিএম বুথ।

অন্যরকম পুনর্মিলনী ‘কৌরঙ্গি ক্রিক’ গ্রুপ

ঈদের পরে অনেক গ্রুপ বা সংগঠন পুনর্মিলনীর আয়োজন করে থাকে। যে-সম্মিলনের কথা বলছি, সেটি যথেষ্ট ব্যতিক্রম। রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও যে-সব বাঙালি স্বাধীনতার স্বাদ-বঞ্চিত হয়ে আটকে পড়েছিলেন পাকিস্তানে, তাদের একাংশের গ্রুপ। এদের বন্দি রাখা হয় দু’বছর, তখনকার শৈশব-কৈশোরে অবস্থানকারী সন্তানেরাই গ্রুপ তৈরি করে নিজেরা সমবেত হয়েছেন।

করাচির ওই বিমান বাহিনী বেসের নামেই গ্রুপের নামকরণ হয়েছে ‘কৌরঙ্গি ক্রিক’। শনিবার সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে ‘বাংলাদেশ বিমান বাহিনী অফিসার্স মেসে’ আয়োজিত হয় এ হৃদয়গ্রাহী দ্বিতীয় সমাবেশ। যেটিতে যোগ দিয়ে আমরা সবাই ফিরে গিয়েছিলাম অর্ধশতাব্দীকাল আগে।

শৈশবের বন্ধু-সহপাঠী ও বড়-ছোট ভাই-বোনদের সঙ্গে স্মৃতিচারণে মেতে প্রকৃতপক্ষে আমাদের সম্মিলিত এবং ব্যক্তিগত শৈশবকালীন স্মৃতির দর্পণের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতালাভ ঘটেছিল; যা আমার বিবেচনায় মিশ্রছন্দময়। আনন্দ ও বেদনায় মেশা। কেননা অভিভাবকদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন (আজ বেঁচে থাকলে তাঁদের কেউ হতেন প্রায় শতর্বষী!)। কোভিড ও অন্যান্য দুর্বিপাকে আমাদের বেশ ক’জন আপা ও ভাইয়া চোখের আড়ালে চলে গেছেন।

আমার তো বহু যুগ পরে মনে পড়ে গিয়েছিল পাকিস্তানী উর্দুভাষী খেলার সাথীদের কথা। চকচকে গোলাকার মার্বেল ছোড়া, পরিত্যক্ত সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে অবাক করা এক খেলা এবং রাবারের বল দিয়ে ক্রিকেট খেলার সাথীদের কথা। যাদের সঙ্গে জীবদ্দশাতেই ঘটে গেছে চিরবিচ্ছেদ। 
তখন আমাদের খুব কঠিন সময়। করাচির বিমান বাহিনীর ছোট্ট বেসের কলোনিতে আমরা, মানে সব বাঙালি পরিবার প্রাথমিকভাবে নজরবন্দি হয়ে আছি একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরের পরে। তখনো দূরের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে, বুলান্দ হিলের বেশ কিছু বাংলোয় অনেকটা গাদাগাদি করে আমাদের বন্দি রাখা হয়নি। অল্পকালের মধ্যে ডাক এসে গেল কড়াকড়ি বন্দিত্বের। আমাদের কলোনির সব বাঙালি পরিবারকে ট্রেনে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো সারগোদার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের বন্দীশিবিরে। আজ অনুধাবন করতে পারি, অর্থকষ্ট, থাকা-খাওয়ার কষ্ট, স্বদেশে ফেরার অনিশ্চয়তা এবং বন্দিত্বের অনুভূতি আমাদের শত পরিবারকে নিকটতর করেছিল। ফলে আমরা সবাই হয়ে উঠেছিলাম এক বৃহত্তর পরিবারের সদস্য, পরম আত্মীয়। 
একাত্তরে যাঁরা শিশু-কিশোর-কিশোরী আজ তাঁরা সবাই ষাটোর্ধ বটে, এমনকি কেউ কেউ মধ্যসত্তুরে। যাঁদের পেশা শিক্ষকতা, প্রকৌশল ও চিকিৎসা সেবা, ব্যবসা, সাংবাদিকতা ইত্যাদি। শনিবার রাতে তাঁরাই ফিরে গিয়েছিলেন জীবনের অত্যন্ত আনন্দমুখর সময়টায়, অর্থাৎ গভীরতর দুর্ভাবনাহীন ছেলেবেলার নির্মল বর্ণিল দিনগুলোয়। দেশব্যাপী, এমনকি দেশের বাইরে অবস্থানরত করাচির বন্ধুদের একত্রিত করার জটিল ও বিরাট দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করছেন বাল্যবন্ধু বাদশা। তাঁর পোশাকী নাম মো. হারুনুর রশীদ, অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন। অপরদিকে আনন্দ আয়োজনে বিশেষ সহায়তা করেছেন আজম ভাই, মশিউল আজম, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর।

শুধু এঁরা দু’জনই নয়, কৌরঙ্গি ক্রিকের বাঙালি বিমানসেনাদের অনেক সন্তানই স্বাধীন দেশের বিমান বাহিনীতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বলাবাহুল্য র্অধশতাধিক উচ্ছল-উচ্ছ্বসিত নারী-পুরুষের সম্মিলনটি ছিল আন্তরিকতায় ভরা, শান্তি ও আনন্দে উপচে পড়া। যা ভবিষ্যতের সঞ্চয়ে এক পরম সম্পদ।

র‌্যাব পরিচয়ে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা ছিনতাই

ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার আগের দিন এই বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলো। ঢাকার উত্তরায় নগদের ডিস্ট্রিবিউটরের একজন প্রতিনিধির কাছ থেকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) পোশাক পরা একদল লোক ১ কোটি ৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তরা জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আহমেদ আলী জানান, গত শনিবার সকাল ৯টার দিকে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডে এই ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, নগদ ডিস্ট্রিবিউটরের কর্মীরা ডিস্ট্রিবিউটরের বাসা থেকে মোটরসাইকেলে টাকা নিয়ে অফিসে যাচ্ছিলেন।

এ সময় একটি কালো মাইক্রোবাস তাদের থামিয়ে টাকা ভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এডিসি আহমেদ আলী বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন তারা ১ কোটি ৮ লাখ টাকা বহন করছিলেন। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি।’ কাছাকাছি একটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, দুজন লোক একটি মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন, তখন উল্টো দিক থেকে আসা একটি মাইক্রোবাস তাদের পথরোধ করে। কয়েক সেকেন্ড পরে, মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তি একটি ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন ‘র‌্যাব’ লেখা জ্যাকেট পরা কয়েকজন ব্যক্তি তাকে ধাওয়া করেন। ঘটনার সময় অভিযুক্তদের হাতে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। 

চালু হলো চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতাল

১৭ দিন অচলাবস্থার পরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে সার্বিক চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয়েছে। এমনটি ঢাকায় নজিরবিহীনই। প্রথম দিনে চিকিৎসা নিলেন ১৪৫৯ রোগী, ভর্তি হয়েছেন ৬৪ জন। জুলাই আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে কর্মচারীদের সংঘর্ষের জেরে বন্ধ হয়ে যায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। শনিবার সকাল ৮টা থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জরুরি ও বহির্বিভাগের সেবা চালু করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে প্রয়োজনে রোগী ভর্তি রেখেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ রোগীরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে। অভ্যুত্থানে আহতদের মধ্যে চারজন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। অন্যরা ছাড়পত্র নিয়ে চলে গেছেন।

এর আগে গত ৪ জুন জরুরি বিভাগ ও ১২ জুন সীমিত পরিসরে আউটডোরের সেবা চালু করে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। গত ২৮ মে জুলাই আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মী, সাধারণ রোগী এবং তাদের স্বজনদের মধ্যে সংঘর্ষের পর থেকে হাসপাতালটিতে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতালটিতে শুধু জুলাই আহতরা অবস্থান করছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগে খাবার সরবরাহ করেছে। এদিকে সংঘর্ষে অনেক ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা আহত হন। নিরাপত্তার কারণে ডাক্তার-নার্সরা কাজ বন্ধ করে দেন।

পরে ৪ জুন মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে  বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যারা হাসপাতালে থাকার মতো, তারা থাকবে। বোর্ড গঠন হয়েছে। এই বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে তাদের চিকিৎসা কি পর্যায়ে আছে। হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন আছে কিনা। বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৫০ জনকে ছাড়পত্র দিয়েছে। চারজন চিকিৎসাধীন আছেন। পরে তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হলে, সিএমএইচ চক্ষু বিভাগ ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু হাসপাতাল সেবা নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে যোগাযোগ করতে বলেছে বোর্ড। প্রথমদিন পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনী হাসপাতালে টহল দেয়। তবে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। 
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালটি ২৫০ বেডের বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতাল। এখানে আছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি, যা অন্য কোথাও নেই। সারাদেশ থেকে জটিল চক্ষু রোগীদের এখানে রেফার করা হয়। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে জটিল রোগের অপারেশন করা হয়। গড়ে দৈনিক অর্ধ শতাধিক অপারেশন হয়। গত ১৭ দিন হাসপাতালের মেইন গেটে তালা লাগানো ছিল। গ-গোলের কারণে হাজার হাজার রোগী সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখে চিকিৎসক-নার্সদের পাশাপাশি রোগীদের আস্থা ফিরে এসেছে। তারা পুলিশ, র‌্যাাব ও সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। রোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই একটা ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার হতে হবে। হাসপাতাল বন্ধ রাখা উচিত হয়নি। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেন, এখন থেকে পুরোদমে অপারেশন ও চিকিৎসা চলবে। তবে নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়। হাসপাতাল ভাঙচুর করা, রোগীদের জিম্মি করা ঠিক না। যুদ্ধের সময়ও এমনটা হয় না। এতদিন রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এটা দুঃখজনক।  

১৫ জুন ২০২৫ 

[email protected]

×