
ছবি: সংগৃহীত
গত শুক্রবার (১৩ জুন) দিনটি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে আরও একটি অন্ধকার অধ্যায় যোগ করল। বহুদিন ধরে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলে আসা উত্তেজনা এবার রূপ নিয়েছে সরাসরি যুদ্ধে। আর সেই যুদ্ধে যেন একতরফা আগ্রাসনের ছবি তুলে ধরেছে ইসরায়েল। পেছনে আছে তার দীর্ঘদিনের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েল এই দিনে ইরানের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিশাল আকারের বিমান ও ড্রোন হামলা চালায়। লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি, মিসাইল তৈরির কারখানা, রাডার সাইট ও ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার। শুধু তাই নয়, আবাসিক এলাকাও এই হামলা থেকে বাদ যায়নি।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এসব হামলায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২২৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১,২০০ জনেরও বেশি। নিহতদের বড় অংশই সাধারণ বেসামরিক মানুষ। অনেক শিশু, নারী, বয়স্ক মানুষও এই হামলার শিকার। ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীও নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) দাবি করেছে, তারা ইরানের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করতে পেরেছে। তাদের ভাষায়, “তেহরানের আকাশে আমরা সম্পূর্ণ বিমান শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছি।” এমনকি তারা ইরানের একটি রিফুয়েলিং এয়ারক্রাফটেও ২৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে হামলা চালিয়েছে।
এই ঘটনার জবাবে ইরানও চুপ ছিল না। তারা একইসাথে প্রচুর সংখ্যক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়ে মারে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে। এর মধ্যে রয়েছে তেল আবিব, হাইফা, বিয়ার শেভা এবং আশকেলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ইরানের এই পাল্টা হামলায় এখন পর্যন্ত ২৪ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৫৯২ জন।
হাইফায় অবস্থিত একটি তেল পরিশোধনাগারেও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত লেগেছে। এতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড হয়, যা বহু ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। ইসরায়েল দাবি করছে, তারা ১০০টিরও বেশি ইরানি ড্রোন সফলভাবে প্রতিহত করেছে।
এদিকে এই সংঘাত ঘিরে সারা বিশ্বে তীব্র উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। চীন, তুরস্ক এবং জি-৭ গোষ্ঠীর নেতারা দ্রুত যুদ্ধ থামিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে ইসরায়েল এবং ইরান— উভয় পক্ষই এখনো নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বক্তৃতায় বলেছেন, “ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি প্রতিরোধ করতে এই অভিযান চালানো হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “যদি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যা করা যায়, তবে এই যুদ্ধ থেমে যাবে।” তাঁর এই বক্তব্য সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ, এটা সরাসরি একটি রাষ্ট্রীয় নেতার হত্যার ঘোষণা।
এদিকে, জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা IAEA জানিয়েছে, ইরানের নাতান্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে ক্ষতি হয়েছে। তারা বলেছে, বাইরে থেকে তেজস্ক্রিয়তা এখনো নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভেতরে দূষণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি যদি ঘটে, তাহলে তা শুধু ইরানের জন্য নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ভয়ংকর বিপদ বয়ে আনবে।
এই যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলমান পারমাণবিক আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত গোটা অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। শান্তির শেষ চেষ্টাটিও ধ্বংস হয়ে গেল এই ঘোষণার মাধ্যমে।
বিশ্ববাসী আজ তাকিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। কেউ জানে না, আগামী দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে। এতদিন ধরে যে অঞ্চল বারবার আগুনের শিখায় পুড়েছে, এবার কী সত্যিই তা ছাই হয়ে যাবে? ফিলিস্তিনের রক্ত এখনো শুকায়নি, ইয়েমেনে শিশুর কান্না থামেনি, সিরিয়ায় ধ্বংসের দৃশ্য এখনো তাজা। তার ওপর নতুন করে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ গোটা অঞ্চলকে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই যুদ্ধ কেবল দুই দেশের মধ্যকার লড়াই নয়। এর পেছনে আছে জিওপলিটিক্স, মার্কিন প্রভাব এবং দীর্ঘদিনের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের এমন দুঃসাহসী আগ্রাসনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য ও নেপথ্য সমর্থন রয়েছে। ওয়াশিংটন সরাসরি কিছু না বললেও, তাদের ‘নীরব সম্মতি’ পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে।
শেষ প্রশ্ন থেকে যায়— এই আগুন আর কতদূর ছড়াবে? কত মানুষ মারা গেলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে? আর কত শিশু অনাথ হলে বিশ্ব বিবেক জাগবে?
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর প্রতিরোধের শেষ বাতিটিও কি এবার নিভে যাবে? নাকি এখনো সময় আছে শান্তির পথে ফিরে যাওয়ার? উত্তর এখন সময়ই দেবে। তবে ইতিহাস বলে— যুদ্ধ কেবল ধ্বংস আনে, শান্তি নয়।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.