
দেশজুড়ে চিকিৎসাকেন্দ্রের নামে পরিচালিত হচ্ছিল গোপন বন্দিশালা। ‘হাসপাতাল’ ও ‘ক্লিনিক’ কোডনামে চালানো এসব সেন্টার আদতে ছিল গুম হওয়া ব্যক্তিদের আটকে রেখে নির্যাতনের ঘাঁটি। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সর্বশেষ রিপোর্টে এমনই ভয়ংকর চিত্র উঠে এসেছে। এখন পর্যন্ত এমন ১৬টি বন্দিশালার তথ্য মিলেছে, যার অধিকাংশই ছিল র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণে।
‘হাসপাতাল’, ‘ক্লিনিক’ কিংবা ‘গ্লাস হাউস’: তদন্তে মিলল বিভ্রান্তিকর ছদ্মনাম
তদন্ত কমিশনের তথ্যে উঠে এসেছে, রাজধানী ঢাকায় র্যাব-১ এর সদর দপ্তর ও সংলগ্ন একটি ভবনে ছিল এমনই একটি বন্দিশালা, যার কোডনাম ছিল ‘হাসপাতাল’ ও ‘গ্লাস হাউস’। একে কখনো বলা হতো ‘ক্লিনিক’। গুমের শিকার অনেক ভুক্তভোগী এখানেই ছিলেন দিনের পর দিন আটক।
কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন জানান, “আমরা প্রথম ভিজিট করলাম র্যাব ওয়ানে। ভিক্টিমরা যখন বর্ণনা দিচ্ছিল, ওই বর্ণনা অনুযায়ী ওই জায়গা এবং ওই সেলগুলো আমরা পাচ্ছিলাম না। সো আমরা খুঁজতে থাকি। একটা ছিল রেশন রুম, রংটং করা ঝকঝক করছে। সাধারণত কেউ সন্দেহ করবে না। রেশন রুমের পরের রুম থেকেই শুরু হয়েছে যে সেলগুলো পেলাম এবং সেখানে টর্চার চেম্বার ছিল। ভিক্টিমরা যে হুক দিয়ে ঝুলিয়ে রাখার কথা বলত, সেগুলো ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “র্যাব হেডকোয়ার্টারের পাশেই আরেকটা ভবনে ছিল মূল গ্লাস হাউস। ওটাকে ক্লিনিক ও হসপিটাল হিসেবে দেখানো হতো।”
ছয়টি বাহিনী পরিচালিত করত আলাদা আলাদা বন্দিশালা
গুম কমিশনের তদন্তে দেখা গেছে, এই ১৬টি বন্দিশালা পরিচালনা করত ছয়টি নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। কোথাও নিজস্ব কার্যালয়ে, কোথাও আবার ভাড়া করা ভবনে স্থাপন করা হতো সেফ হাউস। এসব জায়গায় দিনের পর দিন আটকে রাখা হতো গুম হওয়া ব্যক্তিদের।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “বগুড়ার পুলিশ লাইন্সের ভিতরে বন্দি রাখা হতো, ব্যাপকভাবে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে। ওটা একটা হাব ছিল, নর্থ বেঙ্গলের হাব। এটা ডিজিএফআই অপারেট করতো। র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি মিলিয়ে ঢাকার মধ্যেই ১৬টি সেন্টার আছে, যার প্রতিটিতে অসংখ্য সেল রয়েছে।”
শত শত ভুক্তভোগীর বর্ণনায় মিলেছে নির্যাতনের প্রমাণ
গুম সংক্রান্ত তদন্তে শুরুতে ধারণা ছিল, গুমের শিকারদের রাখা হতো কেবল ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত ডিজিএফআই পরিচালিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (JIC)। তবে শত শত ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যে উঠে আসে আরও ভয়ংকর সত্য। বর্ণনাগুলো যাচাই করতে গিয়ে তদন্তকারীরা খুঁজে পান ঢাকায় আরও অন্তত চার থেকে পাঁচটি গোপন বন্দিশালার অবস্থান।
সরাসরি অভিযুক্তদের নামসহ রিপোর্ট দিয়েছে কমিশন
গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে কেবল স্থান নয়, উল্লেখ করা হয়েছে কোন বাহিনী, কে বা কারা, কার নির্দেশে এসব অপারেশনে যুক্ত ছিলেন, তাও। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা, কিন্তু এখনো তারা আইনের আওতায় আসেননি।
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান বলেন, “অনেক উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তা যখন গুম কমিশনের রিপোর্টে অভিযুক্ত হন, তখন তারা অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। এত বড় একটা ঘটনার সেফ এক্সিট দেওয়াটা একটা মারাত্মক ধরনের অপরাধ।”
তদন্তে বাধা, অভিযোগ খোদ কমিশনের
গুম কমিশনের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, তারা তাদের কাজের প্রতিটি ধাপে বাধা ও অসহযোগিতার মুখে পড়ছেন। অভিযুক্তদের গ্রেফতার না হলে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সম্ভব নয় বলেও জানান তারা।
সারাদেশে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নামধারী গোপন বন্দিশালার এমন ভয়ংকর চিত্র গোটা রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর নৈতিক সংকটকেই তুলে ধরে। কমিশনের রিপোর্টে থাকা বিস্তারিত তথ্য সামনে এলে রাষ্ট্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে তা নতুন করে ভাবনার জন্ম দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এসব ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকার কী পদক্ষেপ নেয় এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কী উদ্যোগ নেয়া হয়।
সূত্র:https://tinyurl.com/4rj7nrcv
আফরোজা