
.
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিদের কীভাবে গুম করা হতো সেটি গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কমিশন বলেছে, ‘তিন স্তরের পিরামিড’-এর মাধ্যমে গুমের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হতো। গুম করে রেখে গা শিউরে ওঠা রোমহর্ষক নির্যাতনের বাস্তব চিত্রও উঠে এসেছে কমিশনের প্রতিবেদনে।
২০১৭ সালে র্যাব ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে অপহরণ করে ৭২ দিন গুম করে রাখে। ওই ব্যক্তির বর্ণনায় ওপরের নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে। ওই যুবক কমিশনকে রোমহর্ষক নির্যাতনের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘আমার পা বেঁধে ওপর দিকে রেখে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তখন শরীরে কোনো পোশাকই রাখা হয়নি। তারপর খুব সম্ভবত বেতের লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি দুইজনে একসঙ্গে আমাকে পেটাতে থাকে। পরে আমাকে অসংখ্যবার মারতে মারতে এমন হয়েছে যে দেখা গেছে বেঁধে রাখা চোখের কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে অনেক চড়-থাপ্পড় দেয় তারা। সেই সময় চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে গেছে।’
‘পরে যখন একটা সংকীর্ণ জায়গায় রাখা হয় তখন আমি পেছনে হাত দিয়ে দেখি যে রক্ত পড়ছে। আর এই পেটানোর দাগ প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত ছিল। আমি যখন শুয়ে আছি তখন সেখানে থাকা সাইফুল নামের এক ব্যক্তি বলেন, আপনি উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন কেন? আমি বলছি, আমি বসে থাকতে পারছি না। আমাকে ২৫ দিন গায়ে হাত দিয়ে টর্চার করেছে।’
গুম সংক্রান্ত কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের প্রতিবেদনে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। শুধু ওই ব্যক্তি একা নন, আওয়ামী সরকারের আমলে এভাবেই অসংখ্য মানুষকে গুম করে রোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হতো। প্রতিবেদনটি গত ৪ জুন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয় কমিশন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সোমবার গুম কমিশনের প্রতিবেদনের কিছু অংশ গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য দেন।
‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ ঃ আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।
গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। সেখানে গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনেও গুমের শিকার ব্যক্তিদের ওপর রোমহর্ষক নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। ১৯ বছর বয়সী এক যুবক গুম কমিশনের কাছে নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাকে তারা আগে থেকেই ফরমেট সারারাত পড়াইছে, ‘এইটা এইটা বলবা। সকালবেলা আবার পড়াইছে, কোর্টে যাবা, যা যা জিজ্ঞাসা করুক, তুমি এটাই বলবা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। ম্যাজিস্ট্রেটকে আমি বলছি, স্যার, আমি একটু আপনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই, ম্যাজিস্ট্রেটকে যখন আমি বলছি, স্যার, এগুলো আমি করিনি। এরা আমাকে মারধর করে, আমারে জোর করে এগুলো বলিয়ে নিচ্ছে।
‘ম্যাজিস্ট্রেট বলছেন, ঠিক আছে, আমি দেখতেছি। কিন্তু তারপরেও সে এটা আমার বিপক্ষে লিখেছে। কারণ, এতদিন আমারে গুম করে রাখছে, অন্য কোনোদিন কিন্তু তারা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আনতে পারত না? (কিন্তু আসলে) যেদিন তাদের পছন্দের ম্যাজিস্ট্রেট ছিল, সেদিনই তারা আমারে কোর্টে হাজির করছে।’ তার মতো আরও অনেকে এভাবে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন গুম কমিশনের কাছে।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনের পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়, পতিত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে গুম ও আটক হওয়া ব্যক্তিদের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে সরাসরি হুমকি, শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এসবের মধ্যে ছিল মৃত্যুর হুমকি, দীর্ঘমেয়াদি গুম, পরিবারের সদস্যদের ক্ষতির আশঙ্কা এবং বারবার নির্যাতন। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের বলা হতো, নির্ধারিত বক্তব্য না দিলে তাদের মেরে ফেলা হবে কিংবা আরও গুরুতর সাজানো মামলার শিকার হতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ভুক্তভোগীদের স্পষ্ট করে বলে দিতেন, তারা যদি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বাক্ষর না করেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নির্ধারিত বক্তব্য না দেন, তবে তাদের কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। বহুবিধ সাক্ষ্য বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ম্যাজিস্ট্রেটগণ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে কি না তা যাচাই করার জন্য যে ন্যূনতম আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, যারা তাদের নির্যাতন করেছে সেই কর্মকর্তারাই তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করেছেন এবং সেখানে তাদের স্বাধীনভাবে কথা বলার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। ওই সময়েই তাদের আবার রিমান্ডে পাঠানো হতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ম্যাজিস্ট্রেটরা এই বিষয়ে উদাসীন ছিলেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা বিশেষ করে আদালত ও প্রসিকিউশন রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন এবং রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
মামলা পরিচালনার ধরন, আইনি বিকৃতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কমিশন বলছে, এই বিচার ব্যবস্থা তার মৌলিক দায়িত্ব অধিকার রক্ষা ও প্রক্রিয়াগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত থেকে সরে এসে রাজনৈতিক দমনকে বৈধতা দেওয়া এবং বিরোধীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।
গুম সংক্রানমশ তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার ব্যক্তিরা শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হননি, বরং গুমের পরপরই দায়ের করা মিথ্যা ফৌজদারি মামলাগুলোর কারণে তারা চরম অর্থনৈতিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগীদের জন্য কোনো প্রতিকার বয়ে আনেনি। বরং এই দীর্ঘস্থায়ী বিচারিক প্রক্রিয়াটি তাদের জন্য হয়ে উঠেছে এক অনবরত যন্ত্রণা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও দারিদ্র্যের কারণ।
আইনি জটিলতার কারণে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ॥ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে একাধিক মামলার মোকাবিলায় আইনি খরচ বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। অনেক সময় এটি ছিল তাদের দুই বছরের গড় পারিবারিক আয়ের চেয়েও বেশি। কমিশনের ভাষ্যমতে, এই ব্যয়ের গড় ছিল ৭ লাখ টাকা, একটি গড় বাংলাদেশি পরিবারের বার্ষিক আয়ের দ্বিগুণেরও বেশি।
কমিশন বলছে, ‘পরিবারগুলোকে সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়েছে, কিংবা ক্রমবর্ধমান ঋণের নিচে জীবনযাপন করতে হয়েছে। এই ধরনের আর্থিক চাপ প্রাথমিক মানসিক আঘাতকে আরও গভীর করেছে এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য নতুন ধরনের সংকট তৈরি করেছে।’
বারবার আদালতে হাজিরা ও মানসিক বিপর্যয় ॥ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীদের অনেকেই তখন তরুণ বছরের পর বছর ধরে বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। নিয়মিত জামিন শর্তে তাদের বারবার আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে একাধিক মামলা ছিল, সেখানে ভুক্তভোগীদের মাসে বহুবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আদালতগুলোতে যেতে হয়েছে।
এই বিচারপ্রক্রিয়াকে ‘মিথ্যা ও শাস্তিমূলক’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ভুক্তভোগীদের ওপর ‘অমানবিক মানসিক চাপ ও শারীরিক ক্লান্তি’ চাপিয়ে দিয়েছে। ন্যায়বিচার দেওয়ার বদলে এই প্রক্রিয়াটি যেন এক দীর্ঘমেয়াদি শাস্তিতে রূপ নিয়েছিল।
মানসিক আঘাত, বিপর্যস্ত জীবন ও দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি ॥ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদালতের প্রক্রিয়ার বাইরেও, গুমের শিকার ব্যক্তিরা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক প্রভাবের মধ্যে দিয়ে গেছেন। এর জন্য অনেকেরই দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন পড়েছে।
কমিশন এক হৃদয়বিদারক ঘটনার উল্লেখ করেছে, যেখানে এক কিশোরকে গুম করে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখাসহ কারাবাস এবং স্পষ্ট নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। তার অপহরণের সময় সে মাত্র নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এরপর টানা চার বছর তাকে গোপনে আটকে রাখা হয় এবং পরে কারাগারে পাঠানো হয়। সে মুক্তি পায় চরম মানসিক সমস্যাসহ, যা তার জীবনকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটক অবস্থায় ছেলেটির নিরবচ্ছিন্ন কান্না ও নির্যাতনের দৃশ্য এখনো মনে রেখেছেন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। বিভিন্ন গোপন বন্দিশিবির থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত একাধিক ব্যক্তি তাকে শনাক্ত করেন। তবে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে অনেক বছর ধরে ধৈর্য নিয়ে তদন্ত করতে হয়। পরবর্তীতে তাকে একটি সাইকেল মেরামতের দোকানে খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া অবস্থায় তার বাবার সঙ্গে থাকছিল। সে আর পড়াশোনায় ফিরে যেতে পারেনি। পরিবারটি গভীর দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করছে এবং মুক্তির পর শুরু হওয়া জটিল আইনি লড়াইয়ে এখনো তারা বিভ্রান্ত ও ক্লান্ত।
ন্যায়বিচারের নামে আরও যন্ত্রণা ॥ কমিশন তার প্রতিবেদনে উপসংহার টেনে বলেছে, গুম সংক্রান্ত মামলাগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় কোনো প্রতিকার নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি শাস্তিমূলক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। গুম হওয়ার মুহূর্ত থেকে শুরু করে বছরের পর বছর ধরে চলা মামলার শুনানি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় পুরো প্রক্রিয়াটি বারবার আগের ক্ষতিকে পুনরায় উসকে দিয়েছে এবং আরও গভীর করেছে।
কমিশন বলছে, প্রতিকার দেওয়ার বদলে বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক সময় নতুন করে ভোগান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পর্যবেক্ষণগুলো বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার, ভুক্তভোগীদের জন্য সহায়তা এবং রাজনৈতিক স্বার্থে আইনি প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার রোধে কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
এ বিষয়ে একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ন্যায়সংগত আদেশ পালন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কোনো অন্যায় আদেশ পালনে কেউ বাধ্য নন। গুম-খুনের আদেশ যারা বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের বিচক্ষণতার অভাব রয়েছে। এসব অন্যায় আদেশ বাস্তবায়ন করা তাদের দায়িত্ব নয়, সেটি তারা অনুধাবন করতে পারেননি। পতিত শেখ হাসিনার শাসনামলে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।
প্যানেল