ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

টাঙুয়ার হাওরে বিপর্যয়: প্লাস্টিক আর ডিজে পার্টিতে ধ্বংস প্রাণ-প্রকৃতি

এস এম মিজানুর রহমান, সুনামগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ১৭ জুন ২০২৫

টাঙুয়ার হাওরে বিপর্যয়: প্লাস্টিক আর ডিজে পার্টিতে ধ্বংস প্রাণ-প্রকৃতি

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত দেশের একমাত্র রামসার ঘোষিত জলাভূমি টাঙুয়ার হাওর আজ চরম পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি।

পর্যটনের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং উচ্চ শব্দে ডিজে পার্টির কারণে হাওরের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের পথে। হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় মাছ, অতিথি পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও পরিবেশবান্ধব খরচ গাছ।

প্রায় ১০,০০০ হেক্টর আয়তনের এ হাওরটি গঠিত হয়েছে ১৮টি বড় বিল ও ৫১টি খাল নিয়ে। এর চারপাশে রয়েছে অন্তত ৫০টি গ্রাম, যেখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই হাওরের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। হাওরটিতে প্রায় ১৪০টি দেশীয় মাছের প্রজাতি এবং শীত মৌসুমে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে।

প্রতিদিন শত শত পর্যটক হাওরে ঘুরতে এলেও অধিকাংশ হাউসবোট ও ট্রলারে নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ফলে প্লাস্টিক বোতল, চিপসের প্যাকেট, ফোমের থালা, খাবারের মোড়কসহ নানা অপচনশীল দ্রব্য হাওরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এতে মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে, জলজ উদ্ভিদ মারা যাচ্ছে, খরচ গাছের শিকড়ে প্লাস্টিক আটকে গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় জেলে রুবেল মিয়া বলেন, “আগে হাওরে মাছ ধরেই পরিবার চালাতাম। এখন দিনে এক কেজি মাছও পাওয়া যায় না। চারদিকে শুধু বোতল আর মোড়ক ভাসে।”

আরও বিপর্যয় সৃষ্টি করছে উচ্চ শব্দে ডিজে পার্টি, রাতভর গান-বাজনা ও অশ্লীল নৃত্য। হাওরের পরিবেশে ছন্দপতন ঘটছে, শব্দের কারণে পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে।

স্থানীয় মুরব্বি আলী হোসেন বলেন, “আমাদের হাওর ছিল এক শান্তিপূর্ণ জায়গা। এখন এখানে শুধু ডিজে পার্টি আর চেঁচামেচি হয়। নামাজ পড়তে পারি না, রাতে ঘুমানো যায় না।”

শুধু শব্দদূষণ নয়, খাল ও ছড়ার পাশে থাকা পরিবেশবান্ধব খরচ গাছগুলোও ট্রলার বাঁধার জন্য নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে। অথচ এই গাছগুলো মাছের আবাসস্থল হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হাওরের ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকলেও নেই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। পরিচ্ছন্নতা অভিযান সীমিত। টোল আদায় হলেও তার অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে না পরিবেশ সংরক্ষণে। তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চালালেও পর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণে বাস্তবায়ন জটিল হয়ে পড়েছে।”

পর্যটকদের অসচেতন আচরণ নিয়েও রয়েছে প্রশাসনের উদ্বেগ। তিনি জানান, “পর্যটকদের আচরণ আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। হাওরের পরিবেশ রক্ষায় শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পরিবেশ বিজ্ঞানী ও গবেষকরা হাওর রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছেন:

  • প্রতিটি ট্রলার ও হাউসবোটে আবর্জনা রাখার ব্যবস্থা

  • পর্যটকদের জন্য বাধ্যতামূলক আবর্জনা ব্যাগ

  • নির্দিষ্ট বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন

  • উচ্চ শব্দে ডিজে মাইক ও অশ্লীলতা নিষিদ্ধকরণ

  • খরচ গাছ ধ্বংসের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা

  • স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিবেশ রক্ষা কর্মসূচি

  • জাতীয় পর্যায়ে টাঙুয়ার হাওর সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ

হাওরবাসীদের মতে, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে টাঙুয়ার হাওরের স্বকীয়তা। দেশীয় মাছ, অতিথি পাখি, খরচ গাছসহ অমূল্য জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে চিরতরে।

পরিবেশবিদরা সতর্ক করছেন, পরিবেশবান্ধব ও নিয়ন্ত্রিত পর্যটন নীতিমালা ছাড়া এই রামসার সাইটকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

সজিব

×