
সূর্যের রহস্যময় বাইরের আবরণ ‘করোনা’ পর্যবেক্ষণে অভিনব সাফল্য দেখিয়েছে ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ESA)। 'প্রোবা-৩' নামের একটি যুগান্তকারী মিশনে দুটি মহাকাশযান সূর্যের সামনে মিলিমিটার-নির্ভুলতা বজায় রেখে এমনভাবে অবস্থান নেয় যে, একটির ছায়া অন্যটির ওপর পড়ে সৃষ্টি হয় এক কৃত্রিম সূর্যগ্রহণ। পৃথিবীর বাইরে সূর্যের এত কাছ থেকে করোনার এমন পর্যবেক্ষণ এটাই প্রথম।
এই যুগান্তকারী পর্যবেক্ষণটি ঘটেছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ভারতের একটি উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে পাঠানো ইউরোপীয় মহাকাশ মিশন 'প্রোবা-৩' এর মাধ্যমে। এই কৃত্রিম গ্রহণের ফলে সূর্যের তীব্র আলো আড়াল করে শুধু তার বাইরের আবরণ, অর্থাৎ করোনাকেই আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়।
কেন এত আগ্রহ সূর্যের করোনাকে ঘিরে?
সূর্যের করোনা নিয়ে বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞাসার শেষ নেই। এই বাইরের স্তরটি সূর্যের পৃষ্ঠের চেয়েও অনেক বেশি উত্তপ্ত, যা নিজেই একটি রহস্য। সূর্যের পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা যেখানে প্রায় ৫,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে করোনার তাপমাত্রা ১১ লক্ষ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে। অথচ সূর্যের কেন্দ্রে তাপমাত্রা ১ কোটি ৫০ লক্ষ ডিগ্রি হলেও, তাপ বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়লে তা কমে যাওয়ার কথা। বরং সেখানে করোনা হয়ে উঠছে আগ্নেয় উত্তাপে ভরা এক বিস্ময়।
করোনার আরও একটি জটিল দিক হলো এর গঠন। এটি উচ্চ করোনা, নিম্ন করোনা এবং মাঝখানের একটি ফাঁক বা ট্রানজিশন জোনে বিভক্ত। উচ্চ ও নিম্ন করোনার পর্যবেক্ষণের যন্ত্র থাকলেও মাঝখানের ফাঁক সাধারণত শুধু প্রাকৃতিক সূর্যগ্রহণের সময়েই দেখা যায়। প্রোবা-৩ প্রথমবারের মতো সেই ফাঁক পর্যবেক্ষণেরও সুযোগ তৈরি করেছে।
প্রোবা-৩: প্রযুক্তির সাহসে সূর্যের অজানা রাজ্যে
প্রোবা-৩ মিশনে ব্যবহৃত হয়েছে দুটি ভিন্ন মহাকাশযান ‘অক্যালটার’ ও ‘করোনাগ্রাফ’। এরা একে অপরের থেকে ১৫০ মিটার দূরে এক কক্ষপথে ঘোরে এবং প্রতি ১৯ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট অন্তর এক কৃত্রিম সূর্যগ্রহণ তৈরি করে। এই অবস্থান ধরে রাখা হয় টানা ছয় ঘণ্টা।
অক্যালটার মূলত সূর্যের আলো আটকে দেয়, যাতে অপর মহাকাশযানটি সূর্যের চারপাশের ম্লান আলোকচ্ছটা দেখতে পারে। মাত্র ১.৪ মিটার ব্যাসের একটি ডিস্ক দিয়ে তৈরি করা হয় ৮ সেন্টিমিটার প্রস্থের ছায়া যা যথেষ্ট সূর্যগ্রহণ সৃষ্টি করতে।
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার প্রযুক্তি পরিচালক ডায়েটমার পিলজ এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের প্রযুক্তি সঠিকভাবে কাজ করছে এই অসাধারণ ছবিগুলো সেটিরই প্রমাণ।”
এই দুটি মহাকাশযান স্বয়ংক্রিয়ভাবে কক্ষপথে পরিচালিত হয়, তারা তারামণ্ডল চিনতে পারে এবং নিজস্ব অবস্থান নির্ধারণে জিপিএস ব্যবহার করে।
সূর্য পর্যবেক্ষণে নতুন যুগের সূচনা
২০২৫ সালের জুনের শুরুতে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এবং নাসা প্রথমবারের মতো সূর্যের মেরু অঞ্চলগুলোর ছবি প্রকাশ করে। ‘সোলার অরবিটার’ নামের মহাকাশযানটি নতুন ডিজাইনের কক্ষপথে ঘুরে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র, সৌরচক্র এবং সৌর আবহাওয়া সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করছে।
ESA-র দেওয়া এক বিবৃতিতে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের গবেষক সামি সোলানকি বলেন, “সূর্যের মেরুগুলো এখনো আমাদের কাছে Terra Incognita— এক অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ড।”
এর আগেই, ২০২১ সালে, নাসার পার্কার সোলার প্রোব সূর্যের করোনার ভেতরে প্রবেশ করা প্রথম মহাকাশযান হিসেবে ইতিহাস গড়ে। মহাকাশযানটি সূর্যের ভয়াবহ তাপ ও বিকিরণ সহ্য করতে সক্ষমভাবে তৈরি হয়েছিল।
করোনার রহস্য জানার পাশাপাশি সতর্কতা পৃথিবীর জন্য
প্রোবা-৩ শুধু সূর্যের গঠন জানার জন্য নয়, বরং সৌর আবহাওয়ার আচরণও বুঝতে সাহায্য করছে। বিশেষ করে, করোনা থেকে ছুটে আসা সৌর বিস্ফোরণ বা ‘করোনাল মাস ইজেকশন’ এবং সৌর ঝড়ের মতো ঘটনাগুলো পৃথিবীর টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট ও পাওয়ার গ্রিডে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই গবেষণাগুলোর গুরুত্ব শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা পৃথিবীর প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।
দুটি ইউরোপীয় মহাকাশযানের কৃত্রিম সূর্যগ্রহণের এই সাফল্য সূর্যবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সূর্যের করোনা এবং সৌর আবহাওয়া বিষয়ে যে রহস্যগুলো এতদিন অধরা ছিল, সেগুলোকে ধীরে ধীরে উন্মোচনের পথে এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞান। এই প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক সাফল্য হয়তো ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণাকে করবে আরও সাহসী, আরও বিস্ময়কর।
সূত্র:https://tinyurl.com/mucfrzm2
আফরোজা