
ছবি: সংগৃহীত
আপনি প্রতিদিন নিঃশ্বাসের সঙ্গে অগণিত অদৃশ্য ছত্রাকের স্পোর (বীজাণু) শরীরে নিচ্ছেন—এর অনেকটাই নিরীহ। কিন্তু কিছু ছত্রাক এমনও আছে যারা শরীরে ঢুকে ফুসফুসে বাসা বাঁধে, ওষুধে কাজ হয় না, আর শরীরকে ধীরে ধীরে ভিতর থেকে ধ্বংস করে।
এই ছত্রাকের অন্যতম নাম আস্পারজিলাস (Aspergillus)। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত ফাঙ্গিসাইড ব্যবহারের ফলে এই প্রাণঘাতী ছত্রাক দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু প্রজাতি, যেমন A. fumigatus, A. flavus এবং A. niger, ভবিষ্যতে কোটি কোটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যেভাবে ছড়ায় এবং আক্রমণ করে
আস্পারজিলাস মূলত মৃত গাছপালা, মাটি, শস্য বা প্রাণীর পালকে জন্মায়। এর স্পোর বাতাসে উড়ে বেড়ায় এবং নিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। সাধারণত সুস্থ মানুষের শরীর তা প্রতিহত করতে পারে, কিন্তু দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে এটি ফুসফুসে বাসা বাঁধে এবং 'ইনভেসিভ অ্যাসপারজিলোসিস' নামে প্রাণঘাতী সংক্রমণ ঘটায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত বিস্তার
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. নরম্যান ভ্যান রেইন জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইউরোপের মতো ঠান্ডা অঞ্চলেও এই ছত্রাকের বিস্তার বাড়ছে। একাধিক মডেল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০৯৯ সালের মধ্যে A. fumigatus ইউরোপে ৭৭.৫% এলাকা দখল করতে পারে, যা অতিরিক্ত ৯০ লাখ মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলবে।
আফ্রিকার কিছু অংশ অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ায় ছত্রাক টিকে থাকতে না পারলেও বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে এর বিস্তার ঘটবে।
ওষুধ কাজ করছে না, মৃত্যু হার ৫০% এর বেশি
চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ ‘অ্যাজল’ এর বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে এই ছত্রাক। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধে কাজ হয় না, এবং রোগীর মৃত্যুর হার ৫০% ছাড়িয়ে যায়। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, কৃষিক্ষেতে ব্যবহৃত ফাঙ্গিসাইড আর হাসপাতালের ওষুধ প্রায় একই রাসায়নিক গঠনের—ফলে কৃষিক্ষেত থেকে ওষুধ প্রতিরোধী স্পোর বাতাসে ছড়িয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।
শস্য ধ্বংস ও কোটি কোটি টাকার ক্ষতি
শুধু মানুষের শরীর নয়, এই ছত্রাক বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি করে যুক্তরাষ্ট্রের কোর্ন (ভুট্টা) শিল্পে। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ছত্রাক দ্রুত বাড়ে, শস্যে বিষাক্ত মাইকোটক্সিন তৈরি হয়। অনেক সময় পুরো শস্য নষ্ট হয়ে যায় অথবা বিষ মেশানো দানাকে অন্য দানার সঙ্গে মিশিয়ে পাতলা করে বাজারে ছাড়তে হয়—যা এখনও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
হাসপাতালে বিস্তার ও ভবিষ্যতের ঝুঁকি
রোগী যদি ফ্লু বা কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠতে থাকেন, তখনও এই ছত্রাক আক্রমণ করতে পারে। নির্মাণকাজ বা ধুলিঝড়ের সময় বাতাসে ছত্রাকের স্পোর বেড়ে যায়, যা হাসপাতালের রোগীদের জন্য বিপজ্জনক।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফাঙ্গাল সংক্রমণ শনাক্ত করার প্রযুক্তি এখনও অনেক পিছিয়ে—ফলে চিকিৎসা অনেক সময় দেরিতে শুরু হয়।
প্রতিরোধের উপায় কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর থেকে রক্ষা পেতে কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি:
- জলবায়ু পরিবর্তনের গতি কমাতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে
- কৃষিক্ষেতে বাছাই করে ফাঙ্গিসাইড ব্যবহার করতে হবে
- হাসপাতাল ও খাদ্য ব্যবস্থায় ছত্রাক পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে
- নতুন ধরনের ওষুধ এবং দ্রুত ছত্রাক শনাক্ত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে Aspergillus এবং Candida auris কে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ জীবাণুর তালিকায় যুক্ত করেছে। গবেষকরা বলছেন, “আজকে যেটি ‘ম্যানেজেবল মোল্ড’, তা কাল হয়ে উঠতে পারে ‘নীরব মহামারি’।"
মুমু ২