ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

বিলুপ্তির পরেও মানব জাতিকে ফিরিয়ে আনতে পারে এই স্ফটিক ডিস্ক

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:২৫, ১৫ জুন ২০২৫

বিলুপ্তির পরেও মানব জাতিকে ফিরিয়ে আনতে পারে এই স্ফটিক ডিস্ক

ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রিয়ার হলস্টাট শহরের গভীর এক লবণ গুহায় সংরক্ষিত আছে একটি ছোট্ট স্ফটিক ডিস্ক—যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে পুরো মানব জাতির জিনগত পরিচয়। এই স্ফটিকটির নাম “৫-ডি মেমোরি ক্রিস্টাল”। এতটুকু জায়গায় লুকিয়ে আছে আমাদের তিন বিলিয়ন ডিএনএ অক্ষরের নিখুঁত অনুলিপি। গবেষকরা বিশ্বাস করেন, একদিন যদি মানব জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, এই ডিস্ক হয়ে উঠবে আমাদের অস্তিত্বকে ফিরিয়ে আনার একমাত্র আশা। 

এই সিলিকা ডিস্ক তৈরি হয়েছে বিশ্বের অন্যতম টেকসই কাঁচ (fused quartz) দিয়ে, যা আগুনে ১,৮৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট, বরফের ঠাণ্ডা এবং মহাকাশের বিকিরণ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। এমনকি এতে ১০ টন চাপ প্রয়োগ করেও কোনো ক্ষতি হয়নি। ২০১৪ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এটিকে ঘোষণা করেছিল ‘সবচেয়ে টেকসই ডেটা স্টোরেজ’ হিসেবে।

এই বিশেষ স্ফটিক ডিস্কে তথ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যার নাম ৫-ডি মেমোরি স্টোরেজ। সাধারণত আমরা তথ্য সংরক্ষণ করি দুই বা তিন মাত্রায়—যেমন কাগজে লেখা বা হার্ডড্রাইভে তথ্য রাখা। কিন্তু এই স্ফটিকে তথ্য খোদাই করা হয়েছে পাঁচটি ভিন্ন মাত্রায়। এর মধ্যে তিনটি হলো অবস্থানগত মাত্রা—উচ্চতা (X), প্রস্থ (Y) ও গভীরতা (Z)। বাকি দুটি হলো আলো প্রবাহের বৈশিষ্ট্য—আলোর প্রতিচ্ছন্নতার মাত্রা এবং আলোর ভাঙ্গনের দিক। এই পাঁচটি মাত্রা একসঙ্গে মিলে তৈরি করে এক অভিনব ডেটা স্টোরেজ পদ্ধতি, যাকে বলা হয় “ফাইভ-ডাইমেনশনাল ডেটা এনকোডিং”।

এই স্ফটিকে তথ্য খোদাই করতে ব্যবহার করা হয় এক বিশেষ ধরনের লেজার, যাকে বলা হয় ফেমটোসেকেন্ড লেজার। প্রতিটি লেজার পলসের স্থায়িত্ব এতটাই ক্ষণস্থায়ী যে তা মাত্র এক কোয়াড্রিলিয়ন ভাগ সেকেন্ড—মানে এক সেকেন্ডের এক মিলিয়ন মিলিয়ন ভাগ। এই অতি সূক্ষ্ম সময়সীমায় আলোর ঝলক গ্লাসের ভেতরে তৈরি করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁকা দাগ বা প্যাটার্ন, যেগুলোর প্রস্থ মাত্র ২০ ন্যানোমিটার—যা মানুষের চুলের চেয়ে প্রায় ৬,০০০ গুণ পাতলা। এই দাগগুলোর আকৃতি, অবস্থান এবং আলোর প্রতিক্রিয়া ডেটা হিসেবে কাজ করে।

এই তথ্যগুলো গ্লাসের বাইরের দিকে খোদাই না করে ভেতরে করা হয় বলে তা আগুন, তাপমাত্রা, বরফ, বিকিরণ এমনকি সময়ের ক্ষয় থেকেও রক্ষা পায়। পড়তে হলে একটি শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ ও পোলারাইজড আলো ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ, এই ডিস্কে একবার তথ্য খোদাই করলে তা হাজার হাজার বছর পরেও ঠিকভাবে পড়ে ফেলা সম্ভব। 

 

University of Southampton-এর বিজ্ঞানী পিটার কাজানস্কি এবং তার টিম এই ডিস্কে পুরো মানব জিনোম খোদাই করেছেন। প্রায় ৩.২ বিলিয়ন বেস-পেয়ার অন্তর্ভুক্ত এই ডেটা ১৫০ বার যাচাই করে সঠিকভাবে খোদাই করা হয়েছে। এই প্রকল্পে সহযোগিতা করেছে Helixworks Technologies। ভবিষ্যতে যদি বিজ্ঞান যথেষ্ট অগ্রসর হয়, তাহলে এই জিনগত কোড ব্যবহার করে ফের ‘মানুষ’ সৃষ্টি সম্ভব হতে পারে।

এই ডিস্ক এখন সংরক্ষিত আছে Memory of Mankind archive-এ। ডিস্কের ওপরে খোদাই করা আছে রাসায়নিক উপাদান (H, C, N, O), ডিএনএ বেস (A, T, C, G), ডাবল হেলিক্স ও একটি কোষে ক্রোমোজোম প্রবেশের দৃশ্য—যাতে ভবিষ্যতের বা বহির্জাগতিক অনুসন্ধানকারীরা এর তাৎপর্য বুঝতে পারে।

এই প্রযুক্তি দিয়ে বিপন্ন প্রাণী যেমন পাহাড়ি গরিলা, তাসমানিয়ান ডেভিল বা বিশাল সিকোয়াইয়া গাছের জিনোম সংরক্ষণও সম্ভব। 

মুমু

×