
ছবিঃ সংগৃহীত
গাজা এখন আর শুধু একটি ভূখণ্ডের নাম নয়—এটি এক রক্তাক্ত দলিল, একটি জাতির নীরব চিত্কার, একটি সভ্যতার বিবেকহীনতার কফিনে ঠুকে যাওয়া পেরেক। বাতাসে ছড়িয়ে আছে পোড়া মাংসের গন্ধ, হাসপাতালের বেডে শিশুর মৃতদেহ, মায়ের কোল ফাঁকা আর দিগন্তজুড়ে ধ্বংসস্তূপ। বিশ্ব তাকিয়ে আছে—নির্বাক, নীচ, নিষ্ঠুর।
ইহুদি জাতির ইতিহাসে একসময় গভীর রক্তাক্ততা ছিল—নাৎসি বর্বরতার হাত থেকে পালিয়ে তারা আশ্রয় চেয়েছিল নিরাপত্তার। ইউরোপ তাদের ঠাঁই দেয়নি, ইতিহাসের বইয়ে তাদের স্থান দিয়েছিল হত্যার শিকার হিসেবে। ৬০ লক্ষ ইহুদি যখন গ্যাস চেম্বারে শেষ নিঃশ্বাস ফেলছিল, তখন পৃথিবী চুপ ছিল। সেই নীরবতাই পরবর্তীতে এক রাষ্ট্রের জন্ম দিল—ইসরায়েল।
১৯৪৮ সালে অস্তিত্ব লাভের পর এই রাষ্ট্র গড়ে উঠল আরেকটি জাতিকে ঘরছাড়া করে, ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে, শত শত গ্রাম ধ্বংস করে, লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করে। ‘নাকবা’—অর্থাৎ ‘বিপর্যয়’ নামেই ইতিহাস একে চিহ্নিত করে রেখেছে। আজ সেই বিপর্যয়ের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে ইসরায়েল আবারো ইতিহাসের কলঙ্ক রচনা করছে।
যে জাতি একদিন গ্যাস চেম্বারে ছিল, আজ তারা এক পুরো জনপদকে করে তুলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা বন্দিশালা। গাজায় ২৩ লক্ষ মানুষের উপর চলছে অবরোধ, হামলা, ক্ষুধার্ত রাখা ও হত্যাযজ্ঞ। ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত নিহত হয়েছে প্রায় ৫৭,০০০ মানুষ, যার মধ্যে কমপক্ষে ১৪,৫০০ শিশু। শিশুদের মৃত্যুর গড় হার এমন যে, প্রতিদিন গড়ে ৪০ জনের বেশি শিশু নিহত হচ্ছে। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, বরং পৃথিবীর বিবেকের উপর আঘাত।
আর এই গণহত্যা চলছে “আত্মরক্ষার অধিকার” নামক এক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ভণ্ডামির ছায়ায়। প্রশ্ন হলো—কার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা? যারা বন্দি? যাদের হাতে অস্ত্র বলতে গ্যালনভর্তি পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, আশ্রয় নেই? যারা স্কুলে গিয়ে ফিরে আসে না, হাসপাতালেই যাদের কবর হয়?
এখন আত্মরক্ষার অধিকার যেন এক পবিত্র কৌশল—যার মুখোশের আড়ালে পুড়িয়ে মারা যায় শিশুদের, বোমা ফেলা হয় শরণার্থী শিবিরে, লক্ষ্যবস্তু বানানো হয় স্কুল, মসজিদ ও গির্জাকে। আর বিশ্ববিবেক? তারা ব্যস্ত রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে সভা ডাকে, কিন্তু গাজার জন্য বরাদ্দ থাকে ‘উদ্বেগ’।
গণহত্যার সংজ্ঞা স্পষ্ট—যখন একটি জাতিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়, তার অস্তিত্ব, ইতিহাস, ভবিষ্যৎ সব কেটে ফেলা হয়, তখন তাকে গণহত্যা বলে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই সংকটকে ‘গণহত্যার সম্ভাব্য প্রেক্ষাপট’ বলেছে। অথচ কার্যত কেউই থামানোর পদক্ষেপ নেয়নি।
আজকের ইসরায়েল ধর্মের প্রতীক নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের বাস্তব রূপ। যার নেতৃত্বে আছে চরম ডানপন্থী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যার অধীনে একের পর এক যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, যুদ্ধবিরতি উপেক্ষিত হয়েছে। ডেমোক্রেসি ও মানবিকতার দাবিদার পশ্চিমারা এদিকে চোখ বন্ধ করে রেখেছে—কারণ তাদের অস্ত্র ব্যবসা আর কূটনৈতিক মিত্রতা।
কিন্তু সবকিছুর পরেও, আলো আসে অন্ধকার চিরে। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, টোকিও—বিশ্বজুড়ে ইহুদি এবং অ-ইহুদি তরুণেরা রাস্তায় নেমে বলছে: “Not In Our Name!” তারা বলছে, ইসরায়েল আমাদের নামে কথা বলে না। এই কণ্ঠস্বর প্রমাণ করে, বিবেক এখনো বেঁচে আছে—যদিও তা অসহায়, নিঃস্ব, নিঃশব্দ।
ইতিহাসের বিচার একদিন হয়। হিটলার চিরস্থায়ী হয়নি, নাৎসি পতাকা আজ জাদুঘরে। সেই দিন ইসরায়েলি দখলদারিত্বও ইতিহাসের বিচার কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। তখন হয়তো ইহুদি জনগণ বুঝবে—শিকার থেকে শিকারি হয়ে ওঠার পথ কখনো সম্মানের নয়, বরং তা ইতিহাসের অন্যতম সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিকৃতি।
আজ গাজার শিশুদের চোখে যে অগ্নিস্নান, তা কোনো রকেট প্রতিহত করতে পারে না। তা মানুষের অন্তর্দৃষ্টি বিদীর্ণ করে। বিশ্ব যদি এই সত্যকে অস্বীকার করে, তবে পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা আর কোনো নৈতিক অবস্থান রাখতে পারব না।
কারণ, এই যুদ্ধ কেবল ভূমির জন্য নয়—এটি মানবতার অস্তিত্বের জন্য।
নোভা