ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার এইতো সময়

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৫৮, ১৮ জুন ২০২৫

ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার এইতো সময়

হামজা-জামালদের এমন বাঁধভাঙা উদ্যাপন বারবার দেখতে চান বাংলাদেশের খেলাপাগল মানুষ

হামজা চৌধুরীর লাল-সবুজ জার্সি গায়ে চাপানোর পর থেকেই বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। সামিত সোম, ফাহিমুদল ইসলামের মতো প্রবাসী তারকা যোগ দেওয়ায় ঘরের মাঠে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই ম্যাচ ঘিরে যে উন্মাদনার ঢেউ জাগে, নিকট অতীতে তা দেখা যায়নি। ঢাকা স্টেডিয়ামের উত্তাল গ্যালারি দেখে অনেকেই নব্বইয়ের দশকের স্মৃতি রোমান্থন করে নষ্টালজিক হয়ে পড়েন। গেছে বাংলাদেশ।

ফুটবলে নতুন করে যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে,  কিছু ত্রুটি সত্ত্বেও সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে বড় ম্যাচের সফল আয়োজন, স্পন্সরদের আগ্রহÑ এমনি সব ইতিবাচক বিষয় তুলে ধরতে রাজধানীর একটি ক্লাবে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বাফুফে। প্রশ্ন উঠেছে কোচ হাভিয়ের ক্যাবরেরার কৌশল ও যোগ্যতা নিয়ে। প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলনে খোদ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কার্য নির্বাহী সদস্য শাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া শাহীন বলেছেন,‘আমি এখানে অডিট ও গভর্মেন্ট রিলেশন নিয়ে মন্তব্য করব না।

আমি জাতীয় দল কমিটির সদস্য। সে হিসেবে আমার একটাই এজেন্ডা। কোচ হাভিয়ের ক্যাবরেরার পদত্যাগ চাই। দেশের ১৮ কোটি মানুষের চাওয়া এটি।’ শিলংয়ে ভারতের সঙ্গে গোলশূন্য ড্রয়ের পর ঢাকায় উন্মাদনার ম্যাচে সিঙ্গাপুরের কাছে ২-১ গোলে হেরে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, মাঠের ফুটবলে ফল না এলে এই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে। 
সমালোচকেরা সবচেয়ে বড় দায়টা দিচ্ছেন ক্যাবরেরার ওপর। স্প্যানিশ এই কোচ এর আগে কখনই কোনো জাতীয় দলের হয়ে কাজ করেননি। সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশের হয়ে ৩২টি ম্যাচে ডাগআউটে ছিলেন তিনি। তাঁর দল নির্বাচন বরাবরই প্রশ্নের খোরাক জোগায়। একই সঙ্গে ম্যাচের কৌশলও। সবশেষ শুধু সিঙ্গাপুর ম্যাচেই তো তাঁর কৌশল নিয়ে কত প্রশ্ন! মাত্র কদিন আগে এসে সিঙ্গাপুর ম্যাচের পরদিনই আবার ক্যাবরেরা ছুটি কাটাতে চলে যান স্পেনে।

তার সঙ্গে ম্যাচ নিয়ে কিছুই আলোচনা করতে পারেনি বাফুফের ম্যানেজমেন্ট। সেই ম্যাচ নিয়ে পরে জাতীয় কমিটি পর্যালোচনা করবে বলে জানিয়েছেন বাফুফে সভাপতি। কোচ নিয়ে তাবিথ বলেন, ‘যেটা হয়েছে (শাহীনের বক্তব্য) দুর্ভাগ্যজনক। এটা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করব। আমাদের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। যেখানে জাতীয় দল কমিটি (কোচের কাজ) পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবে। সেখানে কোচিং স্টাফ, খেলোয়াড়, ম্যানেজমেন্ট সবাই জড়িত।

মূল্যায়নের পর আপনাদের প্রশ্ন নেওয়া যাবে এবং উত্তরও দেওয়া যাবে। বর্তমানে আমরা প্রক্রিয়া মেনে এগোচ্ছি।’ চুক্তি অনুযায়ী ক্যাবরেরা বাংলাদেশের কোচের দায়িত্বে থাকবেন আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত। বাফুফে সংবাদ সম্মেলনে এদিন নির্বাহী কমিটির ২১ জনই আমন্ত্রিত ছিলেন। উপস্থিত হয়েছিলেন ১৫ জন। বিভিন্ন কমিটির প্রধানেরা (কয়েকটি বাদে) নিজেদের দায়িত্বসংক্রান্ত পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

তবে আয়োজনজুড়েই ছিল একধরনের পূর্বপরিচিত ছকের পুনরাবৃত্তি। সিঙ্গাপুর ম্যাচে টিকিট এবং দর্শক অব্যস্থাপনাসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সভাপতি। তবে বাফুফের আগামী ছয় মাসের কার্যক্রমে কোনো উল্লেখযোগ্য নতুন ঘোষণা বা ভিন্নমাত্রার উদ্যোগ তেমনভাবে উঠে আসেনি। 
কাজী সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতির চেয়ারে কাটিয়েছেন ১৬ বছর। তাঁর সময়ে দেশের ফুটবলে আধুনিকতার ছাপ খুব একটা পড়েনি। প্রত্যাশার গল্প শোনালেও প্রাপ্তির খাতার পাল্লা অতটা ভারী নয়। সফলতা-ব্যর্থতার কথা সেভাবে তুলেও ধরা হয়নি। সেখানে নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়ালের মিট দ্য প্রেস’ আয়োজন ব্যতিক্রম বলতে হবে। বাফুফের সভাপতি প্রথমেই তুলে ধরেন বাজেটের বিষয়।

আগামী অর্থবছরে ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তাবিথ বলেন, ‘বাজেটে ক্রীড়া খাতে বরাদ্দ হয় স্বল্প। সেটা সকল ফেডারেশনে বণ্টনে আরও সীমিত হয়ে পড়ে। বাফুফের পক্ষ থেকে অনুরোধ, যেন ক্রীড়া খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়। বিগত কমিটি বছরে ৩০ কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে চেয়েছিল। আমরা এখনো চাইনি। তবে আমাদেরও সেই রকম প্রয়োজন।

আমরা স্পনসর ও নানা মাধ্যম থেকে সেটা মেটানোর চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, ‘অনেক কাঠামো পুরানো, অকেজো; এখানে সংস্কারকাজ করে। মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে আর কত দিন! পুরানো কাঠামোগুলো ভেঙে নতুন করে তৈরি করলে ক্রীড়াঙ্গনের কাজে আসবে। ক্রীড়াপণ্যের ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ ট্যাক্স যেন বিবেচনা করা হয়। মওকুফ করা হয় বা কমানো হয়। ভারতে এই ট্যাক্স মাত্র ১২ শতাংশ।’ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে খেলার আগে দুর্বল ভুটানের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলে ২-০ গোলে জিতেছিল বাংলাদেশ।

তা নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি, ‘প্রীতি ম্যাচের ক্ষেত্রে (পুরুষ দল নিয়ে) আমাদের ভাবনা আরও শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খেলা, যাতে দল আরও উন্নতি করতে পারে। এখন আমরা এশিয়ান কাপের জন্য লড়াই করছি। ভবিষ্যতে অলিম্পিক কোয়ালিফায়ার আসবে, বিশ্বকাপ বাছাই আসবে, প্রস্তুত হওয়ার জন্য ওই মানের দলের বিপক্ষে খেলতে হবে।’ দেশের ফুটবল এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার কথা ক্লাবগুলোর। প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে শুধু নামে থাকলেও কাজে সেভাবে পেশাদারির ছোঁয়া নেই। মাঠগুলোর অবস্থাও বিবর্ণ। 
বাফুফে সভাপতি বলেন, ‘মাঠগুলো আমাদের চাওয়া অনুযায়ী উন্নত করতে পারিনি। জাতীয় স্টেডিয়াম আমরা ফিরে পেয়েছি। কিন্তু যে স্টেডিয়ামগুলো আমরা পেয়েছি লিগ চালাতে, সেগুলোয় (মানের) কমতি আছে, সেটা আমরা মানি এবং স্বীকার করি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এসব ক্ষেত্রে আমরা আপনাদের উন্নতি দেখাতে পারব।’ আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে ঘরোয়া ফুটবলের নতুন মৌসুম।

সেখানে নতুনত্বের দেখা মিলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বাফুফে সভাপতি। একই সঙ্গে ক্লাবগুলোকে দেওয়া হবে আর্থিক সহায়তা, ‘নতুন নতুন খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করা ক্লাবগুলোর দায়িত্ব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেডারেশনের দায়িত্ব আছে ক্লাবগুলোকে সহায়তা করার। কারও মাঠ দরকার, কারও আর্থিক সহযোগিতা। যত ধরনের সহযোগিতা তাদের করা যায়, আমরা করব।’ ফিফার অধীনে ৭৫টি দেশে নির্মিত হচ্ছে ফুটবল একাডেমি।

বাংলাদেশ এই তালিকায় না থাকলেও ফিফার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে একাডেমি নির্মাণের ব্যাপারে চুক্তি করতে চায় বাফুফে। জাতীয় দলের আবার মাঠে নামার কথা রয়েছে সেপ্টেম্বরে। ফুটবলে জিততে হলে গোলের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিপক্ষ যেমন হোক, প্রতিটি দলই খেলায় নামে জেতার উদ্দেশ্য নিয়ে। তবে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে সিঙ্গাপুর ম্যাচ নিয়ে বাংলাদেশ দলের প্রত্যাশার মাত্রা একটু বাড়তি ছিল। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পরে রূপ নিয়েছে হতাশায়। হামজা-সামিতদের নিয়ে ডিফেন্স এবং মাঝমাঠ শক্তিশালী হলেও সেই মানের ফরোয়ার্ড না থাকায় প্রত্যাশিত গোল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। 
সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে রাকিব হোসেন অবশ্য গোলের দেখা পেয়েছেন। তবে সেখানে রাকিবের নৈপুণ্যের চেয়ে সিঙ্গাপুরের গোলরক্ষকের ভুলের অবদান বেশি। ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে বেশ কয়েকটি কর্নার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু একেবারে শেষ মিনিটে তারিক কাজীর হেড পোস্টে লাগা ছাড়া আর কোনো সুযোগ সেভাবে তৈরি হয়নি।

×