ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

ইতিহাসে অর্জনে অনন্য দক্ষিণ আফ্রিকা

ফয়সাল আহমেদ

প্রকাশিত: ০০:৫৬, ১৮ জুন ২০২৫

ইতিহাসে অর্জনে অনন্য দক্ষিণ আফ্রিকা

ঐতিহাসিক লর্ডস ময়দানে আরাধ্য ট্রফি নিয়ে টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল

বারবার তীরে এসে তরী ডুবলেও এবার আর ব্যর্থ হয়নি, ঠিক সময়মতো পৌঁছাল কিনারায়। ঘুরে দাঁড়ানোর দারুণ গল্প লিখেই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরল তারা। বলছিলাম দুবার কোয়ার্টার ফাইনাল, একবার ফাইনাল ও ১২বার সেমিফাইনালে গিয়েও হোঁচট খাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার কথা।

অস্ট্রেলিয়াকে ঐতিহাসিক লর্ডসে হাইভোল্টেজ ফাইনাল ম্যাচে ৫ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার (আইসিসি) বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই অসাধারণ জয়ে মুছে গেছে দীর্ঘ সময়ের ‘চোকার্স’ তকমা। ঘুচে গেছে ২৭ বছরের শিরোপা খরা। গড়েছে অসংখ্য রেকর্ড। এই ইতিহাস অর্জনে অনন্য দক্ষিণ আফ্রিকা।
এই জয়ের ফলে বিশ্বজুড়ে কিংবদন্তি ও সাবেক-বর্তমান ক্রিকেট মহলে প্রশংসায় ভাসছে প্রোটিয়ারা। শচীন টেন্ডুলকর থেকে শুরু করে এবিডি ভিলিয়ার্স, কুমার সাঙ্গাকারা থেকে গিবস সবাই বাহবা দিয়েছেন ক্রিকেট বিশে^র নতুন মুকুটধারী দলকে। সুদিনে সবাই প্রশংসা করলেও এই যাত্রায় ক’জনইবা পাশে ছিল! তবে জয়ের পেছনে যে এইডেন মার্করামের দুর্দান্ত ব্যাটিং নৈপুণ্য, চোখ জুড়ানো সেঞ্চুরি ও অধিনায়ক টেম্বা বাভুমার ত্যাগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
অজিদের দেওয়া ২৮২ রানের বড় লক্ষ্যে পৌঁছাতে বড় ভূমিকা পালন করেছেন এইডেন মার্করাম। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে ডানহাতি এই ব্যাটার টেস্ট ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ২০৭ বলে ১৪টি চারের সহায়তায় ১৩৬ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। আর এই বীরত্বগাথা সাফল্য তাকে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে।
প্রোটিয়াদের প্রথম কোনো ব্যাটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার (আইসিসি) টুর্নামেন্টের ফাইনালে সেঞ্চুরি করলেন মার্করাম। যদিও এই তালিকায় আছেন ১৪ জন। তিন ফরম্যাটের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার ফাইনালে তারা ১৫টি সেঞ্চুরি করেছেন। এর আগে যে কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান ছিল ৬১।

হ্যান্সি ক্রনিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৯৯৮ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেই রান করেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টটি ছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির (মিনি বিশ^কাপ) প্রথম আসর। এরপর আর কোনো আইসিসি ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। বিপরীতে যে কোনো আসরের সেরা চারের লড়াই থেকে বারবার ছিটকে পড়ায় ‘চোকার্স’ তকমা পেয়েছে দলটি!
অজিদের বিপক্ষে প্রোটিয়াদের শিরোপা জেতার স্বপ্ন দেখানো মার্করামের সেঞ্চুরিতে বেশ কয়েকটি রেকর্ড হয়েছে। ঐতিহাসিক লর্ডসে তৃতীয় ব্যাটার হিসেবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। আগের দুটি ব্যাটার হলেন অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ স্মিথ ও ট্রাভিস হেড। এ ছাড়া একই ভেন্যুতে আইসিসি ইভেন্টের ফাইনালে সেঞ্চুরি করা ব্যাটারদের মধ্যে মার্করাম তৃতীয়। আগের দুই সেঞ্চুরিয়ান দুই ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ক্লাইভ লয়েড ও ভিভিয়ান রিচার্ডস।
বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে লর্ডসে টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি করা ষষ্ঠ ব্যাটার মার্করাম। এর আগে সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটাররা হচ্ছেন গর্ডন গ্রিনিজ (২১৪, ১৯৮৪), রয় ফ্রেডরিকস (১৩৮, ১৯৭৬), মাইকেল ক্লার্ক (১৩৬, ২০০৯), অজিত আগারকার (১০৯*, ২০০২) ও স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (১০২*, ১৯৩৮)। এ ছাড়া টেস্টে ওপেনারদের মধ্যে চতুর্থ ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি করা ব্যাটারদের তালিকায়ও নাম লেখালেন মার্করাম। চতুর্থ ইনিংসে ৪টি করে সেঞ্চুরি আছে সুনীল গাভাস্কার ও গ্রায়েম স্মিথের। আর মার্করামসহ ৩টি করে সেঞ্চুরি করেন হার্বার্ট সাটক্লিফ, গফ্রি বয়কট, গর্ডন গ্রিনিজ ও গ্রাহাম গুচ।
লর্ডসে টেস্টের প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে আউট হয়ে ফেরার পর দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরির রেকর্ড আছে ৯ জনের। নতুন করে সেই তালিকায় নাম লেখালেন মার্করাম। এ ছাড়া তিনি পঞ্চম প্রোটিয়া ব্যাটার হিসেবে ইংল্যান্ডের মাটিতে এই কীর্তি গড়লেন। এছাড়াও সাবেক প্রোটিয়া ক্রিকেটার ব্রুস মিচেল, গ্রেইম পোলক ও জ্যাক কালিসের নজিরও ছুঁয়েছেন ত্রিশ বছর বয়সী এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। প্রত্যেকেই ইংল্যান্ডের মাঠটিতে এক টেস্টেই শতরানের সঙ্গে পেয়েছেন উইকেটও।
অবশ্য, মার্করামের এই রেকর্ডের পেছনে তাকে সঙ্গ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। হ্যামস্ট্রিং চোট নিয়েও দীর্ঘ সময় ধরে ক্রিজে ছিলেন বাভুমা। মার্করাম-উইয়ান মুল্ডারের ৬১ রানের জুটির পর ধীরস্থির ও ঠা া মাথায় মার্করাম ও বাভুমা মিলে ১৪৩ রানের জুটি গড়েন। যদিও মাত্র ২ রানেই ফিরতে পারতেন বাভুমা। তার স্লিপে তোলা ক্যাচ ধরতে গিয়ে আঙুল ভেঙেছেন স্টিভ স্মিথ, ক্যাচটি হাতছাড়া করেছেন। এরপর বাভুমা-মার্করামের দারুণ বোঝাপড়া প্রোটিয়াদের স্কোরবোর্ড সমৃদ্ধ করে তোলে।
তবে ব্যক্তিগত ৬৬ রানের ইনিংস খেলেই সাজঘরে ফিরতে হয় প্রোটিয়া অধিনায়ককে। এই শিরোপা ঘরে তুলতে পারায় বাভুমা গড়েছেন এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। ভেঙেছেন ১০৪ বছরের পুরনো রেকর্ড। এখন পর্যন্ত ১০টি টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন টেম্বা বাভুমা। যেখানে তিনি ৯টি ম্যাচেই জিতেছেন, বাকি আরেক ম্যাচ ড্র হয়েছে।

গত ১০৪ বছরে বিশ্বের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে নিজের প্রথম ১০ ম্যাচেই অপরাজিত থাকলেন এই প্রোটিয়া তারকা। ১০ টেস্টে অপরাজেয় থাকার এই রেকর্ড এর আগে দেখা গিয়েছিল ১৯২০-২১ সালে। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং ৮ জয় ও ২ টেস্টে ড্র করেছিলেন। এ ছাড়া প্রায় একই সময়ে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক পার্সি চাপম্যান প্রথম ১০ টেস্টে বাভুমার সমান ৯ জয়ের বিপরীতে হেরেছিলেন একটিতে।
পার্সি চ্যাপম্যানের পর বাভুমা টেস্ট ক্রিকেটে টানা নয় ম্যাচে জয় অর্জনকারী দ্বিতীয় দ্রুততম অধিনায়ক।  তবে ১০ টেস্টে ৯ জয়ের সঙ্গে অপরাজেয় থাকার রেকর্ডটি একমাত্র বাভুমার দখলেই আছে। পাশাপাশি তিনি ইতিহাসের দ্বিতীয় অধিনায়ক যিনি ১০টি ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়ার পরও রয়েছেন অপরাজিত। এ ছাড়া অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ১০ টেস্টের মধ্যে ৮টি করে জয়ের রেকর্ড আছে আর্মস্ট্রংসহ ৬ জনের। বাকিরা হলেন-ডগলাস জার্দিন (ইংল্যান্ড), লিন্ডসে হাসেট (অস্ট্রেলিয়া), ওয়াকার ইউনুস (পাকিস্তান), রিকি পন্টিং (অস্ট্রেলিয়া) ও বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড)।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত তারা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টানা ৮ টেস্টে জিতেছে। এর আগে তারা টানা ৯ টেস্টে জয়ের রেকর্ড গড়েছিল ২০০২ সালের মার্চ থেকে মে ২০০৩ সালের মধ্যে।
লর্ডসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লক্ষ্য তাড়ায় জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা। অবশ্য তাদের সমান ২৮২ রান তাড়ায় এই ভেন্যুতে ২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। এর আগে ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৩৪২ রান তাড়া করে টেস্ট জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এদিকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আড়াইশর বেশি লক্ষ্য তাড়ায় তিনটি টেস্টে জয়ের কীর্তি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। এমনকি চারশর বেশি রান তাড়ায়ও তারা অজি ভূমি থেকে জিতে ফিরেছিল।

এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো এই ম্যাচটি। বল হাতে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জ্বলে উঠেছিলেন কাগিসো রাবাদা। একাই শিকার করলেন ৯ উইকেট। বিশ্বজয়ের আনন্দ মুখে নিয়ে রাবাদা বললেন, ‘আমরা এটির যোগ্য। লোকেরা বলছিল আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের মোকাবিলা করিনি। রাবিশ! আমরা এখানে এসে সেরা দলের বিপক্ষেই খেললাম। অস্ট্রেলিয়া পুরো মৌসুমে দুর্দান্ত খেলে এসেছে।’
বিশ^ জয় করবে আর বাহবা পাবে না তা কি করে হয়! ভারতের কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকর এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, ‘টেস্ট ক্রিকেট তার জাদু ছড়িয়েই চলেছে। এমন ফাইনাল যেখানে প্রতিটি সেশনে আলাদা গল্প ছিল, আর সেই ঝড়ের মধ্যেই শান্ত থেকে ম্যাচ শেষ করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। চতুর্থ ইনিংসে মার্করামের ধৈর্য আর  টেম্বা বাভুমার দৃঢ়তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এক শতক যা ইতিহাস হয়ে থাকবে, এক জুটি যা আশাকে ইতিহাসে রূপান্তরিত করেছে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে অভিনন্দন!’
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক এবিডি ভিলিয়ার্স লেখেন, ‘দারুণ জয়! মার্করামের সেই সেঞ্চুরি এবং বাভুমার নেতৃত্ব একসঙ্গে অসাধারণ এক গল্প রচনা করেছে। তাদেরকে স্যালুট জানাই। আমার দুই ছেলেকে নিয়ে এই মুহূর্ত উপভোগ করাটা আজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে।’
ভারতের সাবেক অলরাউন্ডার যুবরাজ সিং লিখেছেন, ‘২৭ বছরের অপেক্ষা শেষে ২০২৫ সালের দলটি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিল। টেস্ট ক্রিকেটের চেয়ে বড় আত্মমর্যাদা আর মানসিক দৃঢ়তার পরীক্ষা আর কিছুই হতে পারে না। মার্করামের সেঞ্চুরি ছিল নিখাদ। রাবাদা, ইয়ানসেন ও এনগিডির বোলিং আক্রমণ ছিল অবিশ্বাস্য। আর বাভুমার নেতৃত্ব ছিল শান্ত ও সাহসী।’

×