
সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতাবোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ ও পরোপকারী এবং উদার মানসিকতা—এগুলো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব একটা অর্জন করা যায় না।
যাপিত জীবনে প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যে জিনিস প্রয়োজন, তা হলো পারিবারিক শিক্ষা। আর এগুলো রপ্ত করতে হলে সর্বপ্রথম পরিবার থেকেই শুরু হতে হবে।
শিশু যখন নিজ থেকেই হাত-পা নাড়তে শিখে, তখন থেকেই মূলত সে পরিবারের বড়দের কাছ থেকে শিখতে শুরু করে। আর তখন থেকেই তার সামনে বাবা-মা ও বড়দের কথা-বার্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বাড়ন্ত শিশুকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ভাল-মন্দ বিষয়ে অবহিত করতে হবে। তার সঙ্গে নরম সুরে, মার্জিত আচরণে বিভিন্ন বিষয়ে শেয়ার করতে হবে। শিশুদের মন-মানসিকতা থাকে খুবই কোমল, তাই খুব সহজেই যে কোনো বিষয়ে তারা শিখে নিতে পারে। অনেক শিশুই দুষ্টুমির ছলে মিথ্যা বলতে পছন্দ করে, বড়রা যখন বুঝতে পারবেন তখন তাদের কর্তব্য আদর-স্নেহের মাধ্যমে বুঝিয়ে তার এই বদ-অভ্যাস থেকে বিরত রাখা।
কোনো অবস্থায়ই শিশুকে গালমন্দ করা যাবে না, এতে সে আরও বেশি উৎসাহী হয়ে উঠবে। বড়দের দেখলে সালাম, তার চাইতে ছোটদের প্রতি স্নেহ, সমবয়সীদের প্রতি সুসম্পর্ক, অন্যকে তাচ্ছিল্য না করা—এগুলো শেখাতে হবে। বিশেষ করে মায়েদের খেয়াল রাখতে হবে, তার সন্তান অন্যদের প্রতি কতটুকু উদার। ছোট্ট বয়স থেকেই মুক্ত মন-মানসিকতা গড়ে না উঠলে তা আর পরবর্তী জীবনে আয়ত্ত করা খুবই দুরূহ ব্যাপার।
একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সন্তানকে গড়ার জন্য বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মাঝে মাঝে কাছে কিংবা দূরে কোথাও উদার প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে। ভ্রমণেও শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। বর্তমান শহুরে সমাজে পরিবারের দুজনই থাকেন নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত। ফলে যতটুকু সময় সন্তানের প্রাপ্য, তা থেকে সে হয় বঞ্চিত। যৌথ পরিবারের অভাবে, গৃহকর্মীর সান্নিধ্যে, ভার্চুয়াল জগতে মেতে থেকে শিশু হারায় তার সুশিক্ষা পাওয়ার মতো সোনালি সময়।
কার্টুন দেখা আর অ্যাডভেঞ্চার গেম খেলে শিশুর মস্তিষ্কে ধারণ করে যত সব উৎকট চিন্তা। আর সেই চিন্তাচেতনা থেকেই শিশু চায় তার বাস্তবায়ন। ছোট থেকেই যেন শিশু পেতে পারে পারিবারিক শিক্ষা, সেই লক্ষ্যে কর্মব্যস্ত প্রতিটি পরিবারের সন্তানের বাবা-মা এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের কর্তব্য—প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় সন্তানকে জিজ্ঞাসা করা, সে ধর্মীয় কর্ম পালন করেছে কি না। শুধু জিজ্ঞাসার মধ্যেই দায় সারলেই হবে না, রীতিমতো তাদের বাধ্য করাতে হবে। যেভাবে আমরা অফিসে থেকেও বাড়িতে ফোন দিয়ে খোঁজ নেই, সন্তান স্কুলের হোমওয়ার্ক ঠিকমতো করেছে কি না। প্রত্যেক ধর্মের অনুশাসনেই আদর্শ, সভ্যতা ও নৈতিকতার শিক্ষা রয়েছে।
ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন মেনে চলার মাঝেই সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অভিভাবকদের কর্তব্য, তার আদরের সন্তানকে সেগুলোর চর্চা করানো। সংসারের দুজনকেই আজকাল চাকরি/ব্যবসা করতে হয়। বাবা-মায়ের এই পরিশ্রম আদরের সন্তানদের নিষ্কণ্টক ভবিষ্যতের জন্য, তাদের বায়না মেটানোর জন্য। তাই তাদের ব্যক্তিজীবনও আলোকিত করার লক্ষ্যে শত ব্যস্ততার মাঝেও কঠোর পরিশ্রমের ফাঁকে সন্তানকে সকালে স্কুলে পাঠানোর আগে বলে দিন—শিক্ষক/শিক্ষিকাকে ও বড়দের দেখলে সালাম এবং তাদের সঙ্গে নম্রতার সঙ্গে শ্রদ্ধা-ভক্তি নিয়ে কথা বলার জন্য।
সহপাঠীদের সঙ্গে বিনয়ী আচরণ ও সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা। যদি কোনো ভুল করেও ফেলে, তবুও যেন সে মিথ্যার আশ্রয় না নেয়—সে বিষয়ে তাকে অভয় দেওয়া। সে যদি কোনো বিষয়ে তার বন্ধুদের সহযোগিতা পায়, তাহলে সে যেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
একজন অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি সমাজে সবচেয়ে ধিকৃত। রক্তচক্ষুর বদলে পরম সোহাগের সঙ্গে সন্তানের ভুলত্রুটি শুধরে দিলে অনেক বেশি কাজে আসে। তাই বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে। তাহলে দেখবেন সন্তান সবকিছুই আপনার সঙ্গে শেয়ার করবে। যে সন্তান শেয়ার করতে শিখবে, সে কখনও আদর্শহীন হবে না। বাবা-মাকে মনে রাখতে হবে, ঘরের পরিবেশ ভালো বলেই যে সন্তান সভ্য, ভদ্র ও আদর্শবান হবে—এ রকম আত্মতৃপ্তিতে ভোগা ঠিক হবে না। কারণ, সবসময় গ্রাম্য সেই প্রবাদ কাজে নাও আসতে পারে।
সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে, বন্ধুত্ব করছে সেদিকেও অনুসন্ধানী চোখ রাখতে হবে। তবে খোঁজ রাখতে গিয়ে যেন সন্তানের সম্মানে আঘাত না লাগে। মনে রাখবেন, মোটামুটি পাঁচ/ছয় বছর বয়স থেকেই আপনার ছোট্ট সোনামণির নিজস্ব সম্মানবোধ সৃষ্টি হয়। অবশ্যই ছোট থেকেই সন্তানকে/সন্তানের সামনে সুশিক্ষার বিষয়ে আলোচনা ও তার মাঝে চর্চার প্রচলন ঘটাতে হবে।
শিক্ষিত হওয়ার জন্য যেমন একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন, তেমনি সন্তানকে সুস্থ মানসিকতার ধারক ও বাহক হওয়ার জন্য সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মতো মননের অধিকারী করে গড়ে তুলতে বাবা-মাকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
সানজানা