
ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার প্রথম সেলফোন উদ্ভাবন করে
১৯৭৩ সালে মোটরোলা কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার প্রথম সেলফোন উদ্ভাবন করে গোটা বিশ্বের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে নতুন বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন। সে সময় ব্যবহৃত প্রথম সেলফোনটির সাইজ ছিল ১৩ী১.৭৫ী৩.৫ ইঞ্চি এবং এর ওজন ছিল ২.৫ পাউন্ড। সেই ফোন কলের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০২৩ সালে তিনি বলেছিলেন বর্তমানে যেসব মোবাইল ফোন মানুষ হাতে নিয়ে ব্যবহার করে, একসময় এগুলোই ইলেকট্রনিক মাইক্রোচিপ আকারে ত্বকের নিচে সংযুক্ত থাকবে। এমনকি এসব ডিভাইস আলাদা চার্জ দেওয়ারও কোনো প্রয়োজন হবে না, কারণ মানুষের দেহই একটা পারফেক্ট চার্জার। মানুষ যখন খাবার খায়, তখন দেহে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, সেখান থেকেই তা চার্জ হয়ে যাবে। বর্তমানে পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার চেয়েও মোবাইল ফোন সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যা বেশি।
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই ব্যক্তিগত সেলফোন ব্যবহার করেন। এমনকি অনেকেরই আছে একাধিক ফোন সেট। ফলে দিন দিন মোবাইল ফোন মানুষের একটা বর্ধিত অংশ হয়ে উঠছে, পরিবেশকে করছে দূষিত। চামড়া নিচে ইলেকট্রনিক মাইক্রোচিপের প্রতিস্থাপন সফল হলে এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। ভবিষ্যতের প্রযুক্তির চেহারা এরকমই হবে। অর্থাৎ মানুষের শরীর আর নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি এভাবেই মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। যদিও অনেকে এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হবে বলে আশঙ্কা করছেন। বিশ্বের অনেক মানুষ, বিশেষ করে সুইডেনে হাজার হাজার মানুষ তাদের হাতের চামড়ার নিচে ইলেকট্রনিক চিপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যেটি আসলে তাদের বাড়িতে ঢোকার চাবি, অফিসের আইডি কার্ড, ব্যক্তিগত এনআইডি কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, এমআরপি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মেডিক্যাল রিপোর্ট, ট্রেনের টিকিট ইত্যাদি। এতে থাকা বারকোডে থাকছে অ্যান্ড্রয়েডে উদ্ধারযোগ্য যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত, ছবি, ভিডিও এবং অডিও।
এই মাইক্রোচিপ দেখতে ছোট্ট সরিষার দানার মতো। শরীরে বসাতে তেমন সার্জারিও দরকার হয় না। সিরিঞ্জের সাহায্যে হাত বা পায়ের চামড়ার নিচে সহজে স্থায়ীভাবে বসানো যায়। সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। নতুন এই মাইক্রোচিপ গোটা বিশ্বে এখন তোলপাড় সৃষ্টি করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে মাইক্রোচিপ। পাশাপাশি মাইক্রোচিপের আপডেট ক্লোন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ-তরুণীরা চামড়ার নিচে, আঙুলের ডগায় মুড়ি-মুড়কির মতো শখের বশে লাগিয়ে নিচ্ছে। আর কিছুকাল পর হয়তো দেখা যাবে সমস্ত পৃথিবীতে মানুষের শরীর আর নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এদিকে মার্কিন বিজ্ঞানীরা ত্বকের নিচে স্থাপন করা যায় এমন এক ধরনের মাইক্রোচিপ তৈরি করেছেন, যার মধ্যে ওষুধও ভরে রাখা সম্ভব।
একই সঙ্গে এটি ওষুধের মাত্রা ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। শরীরের বাইরে থাকা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে এ মাইক্রোচিপের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। ফলে প্রতিদিন যারা ইনজেকশন নিতে নিতে অতিষ্ঠ, তারা কষ্ট সহ্য করা থেকে বেঁচে যাবেন। একই সঙ্গে অন্য রোগীরাও এর সুফল পাবেন। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে মানুষের শরীরে প্রথম মাইক্রোচিপ স্থাপন করা হয় ১৯৯৮ সালে। এরপর গত দশক থেকে যখন প্রযুক্তিটি বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া শুরু হয় তখন থেকেই তা মানব শরীরে স্থাপন করার হিড়িক পড়ে যায়।
তবে হাতের চামড়ার নিচে এইমাইক্রোচিপ ব্যবহার করে বিশ্বে প্রথম তাক লাগিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের নিরাপত্তাকর্মী প্যাট্রিক পাওম্যান। যে কোনো বিল পরিশোধের জন্য নগদ অর্থ, ব্যাংক কার্ড অথবা মোবাইল কোনটিই ব্যবহার না করে এর পরিবর্তে তিনি তার বাম হাতটি খুব সাধারণভাবে দোকানের কনটাক্টলেস কার্ড রিডারের কাছে রাখেন। সঙ্গে সঙ্গেই তার হাতের চামড়ার ভেতর থেকে একটি ছোট এলইডি আলো জ্বলে উঠে এবং বিল পরিশোধ হয়ে যায়। ২০১৯ সাল থেকে তিনি এভাবে বিল পরিশোধ করে আসছেন। চামড়ার নিচে সেট করা চালের চেয়েও ছোট একটি কনটাক্টলেস পেমেন্ট মাইক্রোচিপের মাধ্যমে তিনি এই বিল পরিশোধের কাজ সারছেন। তার মতে চিপটি বসানোর সময় চামড়ার মধ্যে হালকা চিমটি কাটার মতো ব্যথা অনুভূত হয়েছিল।
অনেকটা নাক ও কান ফোঁড়ানোর মতোই। ভবিষ্যতে হয়তো এই মাইক্রোচিপ বসানোর কাজটা করা হবে একজন সাধারণ ডাক্তারের মাধ্যমে, চেতনা-নাশক ওষুধের সাহায্যে। সম্প্রতি (২০২৩ সালে) ইলোন মাস্কের কোম্পানি নিউরালিংক মানব মস্তিষ্কে সফলভাবে কম্পিউটারের মাইক্রোচিপ বসিয়ে সফলতা পেয়েছে। এটিকে টেলিথেরাপি বলা হচ্ছে, কারণ মস্তিষ্কে তারবিহীন এ চিপটি বসানোর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার ব্রেনের মাধ্যমে কম্পিউটার পরিচালনা করতে পারছেন। এক্ষেত্রে তাকে হাত-পা কিছুই ব্যবহার করতে হচ্ছে না। শুধু চিন্তা করেই প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই পদ্ধতি নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক নিউরোপ্রযুক্তি কোম্পানি ব্ল্যাকরক নিউরোটেক মানুষের মস্তিষ্কে চিপ বসায়। নিউরালিংকবাদে আরও কয়েকটি কোম্পানি এমন চিপ বানানোর কাজে নিযুক্ত রয়েছে।
মানুষের চামড়ার ভিতর ডিজিটাল মাইক্রোচিপ বসানোর এই জার্নি শুরু হয়েছে অনেক আগ থেকেই। কুকুর বিড়ালের শরীরে এই মাইক্রোচিপের ব্যবহার বহু বছর ধরেই চলেছে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন নরথ্যাম এই প্রযুক্তির সকল উদ্ভাবক। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডে যে ধরনের প্রযুক্তি থাকে মানুষের হাতে বসানো মাইক্রোচিপটিতেও থাকবে ওই একই প্রযুক্তি। ফলে দোকানে গিয়ে মেশিনে শুধু হাত ছুঁইয়ে দিয়েই মূল্য পরিশোধ হয়ে যাবে। ওই চিপের মধ্যে থাকবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৌলিক কিছু তথ্য। যেমনÑ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যগত তথ্য, ব্যক্তিগত তথ্য, ব্যাংকের তথ্য ইত্যাদি। চাবি বা ব্যাংকের কার্ড নিয়ে মানুষ প্রায়ই ঝামেলায় পড়েন।
কখনো হারিয়ে ফেলেন, কোথায় রেখেছেন হয়তো খুঁজে পান না। কিন্তু ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে এই মাইক্রোচিপের ব্যবহার শুরু হলে একজন মানুষ নিজেই হয়ে উঠতে পারবেন নিজের ঘরের, অফিসের কিংবা গাড়ির চাবি। এটিএম মেশিনে হাত ছোঁয়ালেই বেরিয়ে আসবে টাকা। অর্থাৎ হাতের তালুতে ছোট্ট একটি মাইক্রোচিপ বসিয়েই এ কাজ করা যাবে অনায়াসে। কিউ আর (ছজ) কোড ব্যবহার করে যেভাবে বিকাশ পেমেন্ট বা ফাইল শেয়ার করা হয়, ঠিক একইভাবে এই মাইক্রোচিপ ব্যবহার করছেন ব্যবহারকারীরা। যেই হাতে মাইক্রোচিপ আছে তা অন্যান্য মাইক্রোচিপ ডিভাইস আইডেন্টিফাই করতে পারে এমন ডিভাইসের সামনে ধরলেই কাজ হয়ে যায়।
মাইক্রোচিপকে বিজ্ঞানের ভাষায় বায়োহ্যাকিং টেকনোলজি বলা হয়। সংক্ষেপে বায়ো হ্যাকিং হচ্ছে মানব শরীরের অভ্যন্তরে কোন ডিভাইস বসানো। মাইক্রোচিপ দেখতে একটি সরিষার দানার সমান। ন্যানো প্রযুক্তির ছোট্ট এই ইলেকট্রনিক ডিভাইসটি আরএফআইডি (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) পদ্ধতিতে কাজ করে। অনেকটা এটিএম কার্ড বা ক্রেডিট কার্ডের মতো। পার্থক্য শুধু এটি হাতের চামড়ার ভেতরে প্রবেশ করানো হয়েছে। অনেকটা ভ্যাকসিনের মতো। ফার্মাসিস্ট এবং ওষুধ বিশেষজ্ঞদের মতে এটি দীর্ঘদিন হাতের চামড়ার নিচে থাকলে তেমন কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। বায়োহ্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল নামে সুইডেনের একটি কোম্পানি এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করে ভালো ফল পেয়েছে।
বর্তমানে সুইডেনের প্রায় চার হাজার মানুষ এটি তাদের হাতে ব্যবহার করছেন। এতে গড়ে ১৮০ ডলার খরচ হয়েছে। তবে মাইক্রোচিপ ব্যবহারে অনেক ঝুঁকি ও অসুবিধাও আছে। যেমন- এই চিপ হাতের মধ্যে থেকে সরে গিয়ে শরীরের অন্য কোথা ও চলে যেতে পারে। এটি হতে ইনফেকশন হওয়া, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন হতে পারে। হ্যাকিংয়ের সমস্যা তো আছেই। সুবিধা-অসুবিধা, চ্যালেঞ্জ যাই খাকুক না কেনো, চামড়ার নিচে মাইক্রোচিপের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ভবিষ্যতে হয়তো ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের অন্যান্য দেশে। এটি পশুপাখি ট্রেকিং করতে, মালামাল পরিবহন এবং আরও নানা কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। খুব শীঘ্রই হয়তো মোবাইলের ও অন্য অনেক ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের পরিপূরক হিসেবে এই মাইক্রোচিপকে দেখা যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়