
হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানব জাতির হিদায়াতের জন্য অসংখ্য নবী ও রাসুল দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন আল্লাহ সুবহানাহু অতা’য়ালা। মানব জাতির হেদায়াতের গাইডলাইন হিসেবে নাজিল করেছেন অসংখ্য আসমানি কিতাব। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ ৪টি আসমানি কিতাব হলো তাওরাত, জবুর, ইঞ্জিল, ফুরকান (কুরআন)। মানব জাতি সৃষ্টিকুলে আশ্রাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব, কিন্তু এই সেরা জীবই কখনো কখনো পশুর বৈশিষ্ট্য অতিক্রম করে থাকে।
মানুষ যাতে তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখে। তার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা আসমানি কিতাবসহ যুগে যুগে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন ধরার বুকে। মানব জাতিকে আলোর পথ দেখাতে। সমৃদ্ধময় ঐশী বাণীগুলোকে ‘কিতাব’ বলা হয় এবং ছোট ছোট বাণীগুলোকে বলা হয় ‘ছহিফা’। হিব্রু ভাষায় নাজিল করা হয় তাওরাত, হজরত মুসার (আ.) ওপর। জবুর হজরত দাউদের (আ.)-এর ওপর, হিব্রু ভাষায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ইনজিল হজরত ঈসার (আ.) ওপর। ইনজিলের প্রাচীন যে কপি এক সময় পাওয়া যেত, তা গ্রিক ভাষায় হওয়ায় অনেকের দাবি যে ইনজিল ইউনানি বা গ্রিক ভাষায় ছিল। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব আল কুরআন নাজিল হয়েছে শেষ রাসুল বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদের (সা.) ওপর আরবি ভাষায়। এসব কিতাবেই আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়তের বিধান সুবিন্যস্ত হয়েছে বিভিন্ন যুগের চাহিদার নিরিখে।
সুরা বাকারার ১২৯নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে আমাদের রব! আপনি তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রাসুল পাঠান, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের কাছে উপস্থাপন করবেন; তাদের কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পরিশুদ্ধ করবেন আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’।
সুরা আশশুরার ৫২নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘মহান আল্লাহ জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য।’ তাদের নিকট রাসুল পাঠিয়েছেন একের পর এক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুগে। তারা যেন আল্লাহর প্রতি কোনোরূপ দোষারোপ করতে না পারে, তাদের আলোর পথ দেখানো হয়নি।
ওহি-ই হলো পথ প্রদর্শনকারী, মহান আল্লাহ বলেন- ‘এভাবে আমি তোমার প্রতি অহি নাজিল করেছি রুহ তথা আমার নির্দেশ। তুমি তো জানতে না কিতাব কি ও ইমান কি। কিন্তু আমি তাকে করেছি আলো, যার সাহায্যে আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা পথ দেখাই।’
মুহাম্মদের (সা.) গোটা জীবনটাই ছিল আল কুরআনের ফলিত দর্শন। তাঁর সমগ্র জীবন-চরিত। মহান আল্লাহ আরও বলেন ‘তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ কারণ, তিনি অহির নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়েছেন। ফলে, তাঁর জ্ঞান ও কর্মকাণ্ড সেই অনুযায়ী ঢালাই হয়েছে। এভাবে অহি হয়ে গেছে তাঁর পরিচালক।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আল্লাহর অহির হুকুমের প্রবক্তা, তাঁর অনুগত এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। তাঁর এ বৈশিষ্ট্যই ছিল তাঁর প্রতি আরোপিত সত্যের সপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ। যখনই তাঁর প্রতি হুকুম এসেছে, তিনি তা পালন করেছেন। যখনই কোনো বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, তিনি তা বর্জন করেছেন। যখনই ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে, তিনি সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক ভীত হয়েছেন। মোট কথা তিনি আল্লাহর নাজিলকৃত শরিয়তকে নিজের জীবনে সুচারুরূপে বাস্তবায়ন করেন এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সত্য-সঠিক পথ পাড়ি দেন। এ কারণে আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে তাঁর প্রশংসা করেছেন। আল্লাহর প্রতি তাঁর আত্মসমর্পণ ও বন্দেগির প্রশংসা করে তাঁকে তাঁর সত্যনিষ্ঠ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি শরিয়ত সমগ্র মানব জাতির ওপর কর্তৃত্বশীল, তাদের জন্য হয় আলোর দিশা। এ আলোয় তারা এগিয়ে চলেন সত্যের পথে। যখন তারা নিছক মানবিক বুদ্ধিবৃত্তি ও জাতীয় মর্যাদার ভিত্তিতে নয়, বরং শরিয়তের বিধানসমূহ মেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী কথা, কাজ ও বিশ্বাসের মাধ্যমে জীবন গড়ে তোলেন, তখন জীবন হয় মর্যাদাবান। কারণ, আল্লাহ মর্যাদাকে সম্পৃক্ত করেছেন তাকওয়ার সঙ্গে, অন্য কিছুর সঙ্গে নয়।
আল্লাহ বলেন: ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই মর্যাদাশালী যে আল্লাহকে ভয় করে। (সুরা হুজরাত, আয়াত-৪)। কাজেই মানুষের মধ্যে যারা শরিয়তের সর্বাধিক আনুগত্য ও সংরক্ষণকারী, তারাই সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। অন্যথায় মানুষের উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত হওয়া অর্থহীন ও সুদূরপরাহত।
আল্লাহর প্রদত্ত শরিয়তের বিধান পরিপূর্ণরূপে মেনে চলার ওপরই মানুষের মর্যাদা নির্ভরশীল। আর ইসলামি শরিয়তের এ বিধান কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে এবং এর মাধ্যমে অন্য সকল নবী-রাসুলের শরিয়ত বাতিল বলে গণ্য।
যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাঁর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করে, এ শরিয়ত তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে অনাবিল সুখ ও শান্তিতে ভরিয়ে দেয়। যে ব্যক্তি এ পথে চলে, সে বিপথগামী হবেন না এবং দুঃখ-কষ্টও পাবেন না। আর যে ব্যক্তি এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন যাপন হবে সংকুচিত এবং কিয়ামতের দিন সে উত্থিত হবে অন্ধ অবস্থায়, আপাত দৃষ্টিতে তাকে যতই সুখী ও সততার অধিকারী দেখা যাক না কেন। কাজেই আল্লাহর প্রতি ইমান এবং কথায় ও কাজে তাঁর শরিয়তের আনুগত্যই পবিত্র ও শান্তিময় জীবনের একমাত্র ধারক ও বাহক।
(আগামী শুক্রবার সমাপ্য)
লেখক : সাংবাদিক
প্যানেল