
ব্যস্ত নগরী ঢাকা যেন আন্দোলনের নগরীতে পরিণত হয়েছে
ব্যস্ত নগরী ঢাকা যেন আন্দোলনের নগরীতে পরিণত হয়েছে। যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক দাবি যাই হোক, সবাই নেমে আসছে রাস্তায়। সড়ক অবরোধ করেই যেন আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা তাদের। আন্দোলনের এই চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা অবস্থা নগরবাসীর। ঘর থেকে বের হলেই যাত্রাপথের স্বাভাবিক রাস্তা যেখানে ১০ মিনিটে পার হওয়া যেত, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে। অফিস কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়া মানুষগুলোর দুর্ভোগের যেন শেষ নেই।
সড়ক অবরোধের প্রভাবে ভোগান্তিতে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। বিশেষ করে ঘন ঘন অবরোধ, বিক্ষোভ, সংঘর্ষের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সব রাস্তা বন্ধ হয়ে পড়ায় তীব্র যানজটে জনভোগান্তি বাড়ছে। গত সপ্তাহ থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবস্থান, ছাত্রদল নেতা হত্যায় বিচার চেয়ে সড়ক অবরোধ, বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে সড়ক অবরোধ ও আন্দোলনের ফলে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সবাইকে।
বৃহস্পতিবারও রাজধানী ঢাকার চিত্র ছিল একই। শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও কাকরাইল মোড় অবরোধের ফলে সেখানকার ও আশপাশের সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এই যানজট ছড়িয়ে পড়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। এরই মধ্যে সকালে শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে নগরীর অনেক সড়ক ও অলিগলি ডুবে যায়। সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। সব মিলে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যা মামলার তদন্তে গাফিলতির প্রতিবাদ এবং হত্যাকা-ে জড়িত মূল ঘাতকসহ সব আসামিকে গ্রেপ্তার, সুষ্ঠু বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে সকাল সাড়ে ৯টায় ছাত্রদল নেতাকর্মীরা শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। ফলে ওই এলাকা দিয়ে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে রাতভর অবস্থানের পর বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে মৎস্য ভবন ও কাকরাইল মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে গেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নতুন মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে এ আন্দোলন। দ্বিতীয় দিনের মতো বৃহস্পতিবার ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে গত কয়েক দিনের মতো বৃহস্পতিবারও ওই এলাকার সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. সরওয়ার বলেন, ঢাকার অনেক রাস্তাই অবরোধের কারণে বন্ধ। এর পর বৃষ্টির কারণে অনেক সড়ক ডুবে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের ট্রাফিক পুলিশেরও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অবরোধ উঠে গেলে সড়ক স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে সকাল সকাল অফিসে ছুটতে শুরু করেন চাকরিজীবীরা। কেউ বের হয়েছেন রোগী নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে, শিক্ষার্থীরা ছুটেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে যানবাহন নিয়ে বের হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এ ছাড়া প্রয়োজনে কাজে বের হয়েছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু শাহবাগ, মৎস্য ভবন ও কাকরাইল হয়ে যাতায়াতকারী সবাইকে পথিমধ্যে থামতে হয়েছে। কেননা, সকাল সকাল এখানকার সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নামেন ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মীরা।
সকাল সাড়ে ৯টায় ছাত্রদল নেতাকর্মীরা শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ইউনিট অনুযায়ী খ- খ- হয়ে ভাগ হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় তারা, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে; আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না; সাম্য ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না; বিচার বিচার বিচার চাই, সাম্য হত্যার বিচার চাই; অবিলম্বে করতে হবে স্লোগান দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, সাম্য হত্যার বিচার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ইউনিটের ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাকর্মীরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে বিক্ষোভ কর্মসূচি।
সকাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি অবরোধের ফলে ওখান দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন দিক থেকে এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের জটলা সৃষ্টি হয় আশপাশের সড়কে। সেই যানজট ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্র। দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে আসা যানবাহন শাহবাগ সিগন্যাল দিয়ে বের হতে না পেরে সায়েন্সল্যাবের দিকে চলে যায়। এতে ওই সড়ক গাড়িতে ঠাসা হয়ে পড়ে। সায়েন্সল্যাব থেকে আসা পরিবহনগুলোকে পুলিশ ঘুরিয়ে হাতিরপুল দিয়ে যেতে বাধ্য করে। পরিবহনগুলো হাতিরপুল হয়ে বাংলামটর, মগবাজার, মালিবাগ হয়ে দক্ষিণে গন্তব্যে পৌঁছায়।
মিরপুর থকে শাহবাগ গামী পরিবহনের দীর্ঘ লাইন দেখা যায় বাংলামটর থেকে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল সিগন্যাল পর্যন্ত। উপায় না পেয়ে এসব পরিবহনগুলো সংরক্ষিত এলাকা মিন্টু রোড হয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। দুপুরের দিকে বাংলামটর থেকেই যানবাহন ঘুরিয়ে মগবাজার দিয়ে যেতে বাধ্য করে পুলিশ। আর মৎস্য ভবনের দিক থেকে শাহবাগের দিকে আসা যানবাহনকে পড়তে হয়েছে আরও বিপাকে। এই যানবাহনগুলো বায়ে শাহবাগ থানার সামনে দিয়ে ঘুরে সায়েন্সল্যাবের দিকে চলে যায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকে গাড়ি। ফলে মৎস্য ভবন, সায়েন্সল্যাব, কারওয়ান বাজার, বাংলামটর, মগবাজার, মালিবাগের সড়কে গাড়ির চাপ পড়ে। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের।
স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে বাইকে করে শাহবাগের বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক পিজি) হাসপাতালে এসে বিপাকে পড়েন নিলয়। ঢাবি হয়ে শাহবাগ সিগন্যাল দিয়ে যেতে না পেরে নিলয় আন্দোলনকারীদের ঘেঁষে পশ্চিম পাশ দিয়ে হাসপাতালে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাকে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। আন্দোলনকারীরা জানান, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র থাকলে ঢুকতে দেওয়া হবে। নিলয় তাদের জানান, তিনি মাত্র চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। তাহলে চিকিৎকের ব্যবস্থাপত্র থাকবে কোথায় থেকে। কিন্তু সোজাসাপ্টা এই যুক্তি মানতে নারাজ আন্দোলনকারীরা। ফলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে কাঁটবন সিগন্যাল ঘুরে যানজট ঠেলে হাসপাতালে আসতে হয়েছে তাকে।
নিলয় বলেন, তার স্ত্রীর চিকেন ফক্স হয়েছে। স্ত্রীর অসুস্থতায় তারা সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। দ্রুত কিভাবে চিকিৎসকের কাছে যাবেন সেই চিন্তা তার মাথায়। ওদের সঙ্গে (আন্দোলনকারী) তর্কে জড়ালে সময় অপচয় হবে। তাই তিনি বাধ্য হয়ে ঘুরে হাসপাতালে এসেছেন। তবে কথাগুলো বলতে বলতে ক্ষোভে ফেঁটে পড়েন তিনি।
নিলয়ের মতো অনেককে ওখান দিয়ে যেতে দেননি আন্দোলনকারীরা। আখ মাড়াই করার মেশিন, বাইক, পুলিশ ব্যারিকেড টেনে বাইক যাওয়ার সামান্য রাস্তাটুকুও বন্ধ করে রাখেন তারা। অনেক বাস যাত্রী বাস থেকে নেমে আন্দোলন স্থল পায়ে হেঁটে আবার বাসে উঠেন। সায়েন্সল্যাব থেকে আগত বাস থেকে অনেক যাত্রীরা কাঁটাবন সিগন্যালে বাস থেকে নেমে যান। তারা শাহবাগ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেন। এরপর মৎস্য ভবন, সচিবালয়ে যাওয়ার জন্য রিকশা নেন। মিরপুর গামী যাত্রীদেরও এরকম পায়ে হেঁটে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল অতিক্রম করে গাড়িতে উঠতে দেখা গেছে। এসময় তারা ক্ষোভ ঝাড়তে থাকেন। কেউ কেউ বলেন, এখানে (শাহবাগে) ত্রিশটা দিনই আন্দোলন থাকে। একাদিনও যথা সময়ে অফিসে যাওয়া সম্ভব হয় না। এখান দিয়ে উড়াল সড়ক করার উচিত। না হয় আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের জন্য উদ্যান বা অন্যত্র জায়গা করে দেওয়া উচিত।
সকাল ১০টার পরপর ঝুম বৃষ্টি নামে নগরীতে। বৃষ্টি শুরুর পর যানজট বাড়তে থাকে। এরপর যখন বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় তখন দুর্ভোগ বেড়ে যায়। জলাবদ্ধতার কারণে রিকশা, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে সড়কের মাঝে আটকে থাকতেও দেখা যায় অনেক এলাকায়। রাস্তায় পানি জমে থাকায় পথচারীদের হেঁটে গন্তব্যে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
দুপুর গড়াতেই যানজটের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কেননা, সরকারি অফিস ছুটি হতেই সড়কে গাড়ির চাপ বাড়তে থাকে। শাহবাগ, মৎস্য ভবন ও কাকরাইল সড়ক অবরোধের তথ্যে সবাই আশপাশের সড়ক দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু একই সঙ্গে একই সড়কে অধিক গাড়ির চাপের ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে সারা দিন অফিস শেষে বাসায় ফেরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দীর্ঘ যানজটে পড়তে হয়েছে।
টানা আন্দোলনে বিরক্ত নগরবাসী ॥ বেশ কয়েকদিন ধরে ‘মানব সৃষ্ট’ যানজটের ফলে চরম বিরক্ত নগরবাসী। ঘর থেকে বের হলেই যেন ভোগান্তিতে নেমেছেন। তাই একেবারে প্রয়োজন ছাড়া বের হন। তবে নগরীর অধিকাংশ বাসিন্দাকেই প্রতিদিন কোন না কোন কাজে বের হতে হয়। আর এতে জীবন ভীষিয়ে উঠছে তাদের।
বেসরকারি চাকরিজীবী হুমায়ূন কবির বলেন, প্রতিদিন কোন না কোন সংগঠন সড়ক অবরোধ করছে, আন্দোলন করছে। সব কিছুর একটা সীমা থাকে। আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না। গত কয়েক দিন ধরে হাতে সময় নিয়ে বের হয়েও তিনি নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারেননি। এভাবে চলতে থাকে এই শহর আরও অযোগ্য শহরে পরিণত হবে।
বেশ কয়েকজন শাহবাগের ফুটপাত ধরে হাঁটছিলে। হাঁটতে হাঁটতে একে অপরের সঙ্গে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, ফুটপাত ধরে যে হাঁটবো সেই সুযোগও নেই। হাত দিয়ে ওখানকার ফুটপাতে বসা দোকানিদের দেখিয়ে একজন বলেন, দেখেন- ছোট্ট এই ফুটপাতেও দোকান বসিয়ে মেডিক্যাল সরঞ্জামাদি বিক্রি করা হচ্ছে। মানুষ কোথায় যাবে, কোন পথ ধরে হাঁটবে। রাস্তায় যানজট, ফুটপাতে জনযট। সরকার কি এসব দেখে না?