
.
ইন্টারনেটে বিশাল একটি জায়গা দখল করে আছে ডিজিটাল মার্কেটিং। এই ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের রয়েছে অনেক শাখা-প্রশাখা। এর মধ্যে সিপিএ (CPA) মার্কেটিং অন্যতম। সিপিএ মার্কেটিংয়ের পূর্ণ নাম হলো Cost Per Action, যার অর্থ হলো, কোনো অ্যাকশন বা কাজের ওপর অর্থ খরচ করা। এখানে বিজ্ঞাপনদাতারা প্রতিটি ক্রেতা বা সম্ভাব্য গ্রাহক অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ প্রদান করেন। এটি একটি কার্যকর মার্কেটিং কৌশল কারণ এটি বিজ্ঞাপনদাতাদের তাদের বিপণন ব্যয়কে ট্র্যাক করতে এবং তাদের বিনিয়োগের প্রতিদান (Return on Investment) পরিমাপ করতে দেয়। যখন কেউ আপনার বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে এবং আপনার পণ্য বা পরিষেবা অর্জন করে, তখন আপনি বিজ্ঞাপনদাতা থেকে অর্থ পাবেন। অর্থ প্রদানের পরিমাণ পণ্য বা পরিষেবার মূল্য বা অর্জনের ধরনের ওপর নির্ভর করে। একটু গুছিয়ে বলতে গেলে, সিপিএ মার্কেটিং হলো ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের এমন একটি শাখা, যার মাধ্যমে ইন্টারনেটের সহায়তায় অনলাইনে কোনো প্রোডাক্ট, বিজনেস অথবা সার্ভিসের রেফারেন্স শেয়ারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল মার্কেটিং ঘটিয়ে তার বিনিময়ে কমিশন লাভের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা হয়। এক্ষেত্রে সিপিএ মার্কেটিং অনেকটাই অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংয়ের মতো। তবে এই দুটোর মাঝে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্যও রয়েছে বিস্তর। অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং হলো অনলাইনে পণ্যের মার্কেটিং ঘটিয়ে পণ্য বিক্রি করা এবং তার ওপর কমিশন পাওয়া। অর্থাৎ আপনার কনটেন্ট দ্বারা উৎসাহিত হয়ে যদি কেউ পণ্য কিনে তবে আপনি টাকা পাবেন অথবা পাবেন না। কিন্তু সিপিএ মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে আপনি যদি নির্ধারিত কাজটি সঠিকভাবে করতে পারেন তবেই আপনি কমিশন লাভ করবেন। অর্থাৎ রেফারেন্স লিংকের মাধ্যমে ইউজারদের যদি নির্ধারিত কাজের ওপর লিড করাতে পারেন তবেই আপনার কমিশন নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে কোনো প্রোডাক্ট বিক্রি হলো কি হলো না তা আপনার আয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
সিপিএ মার্কেটিং হলো একটি অ্যাডভার্টাইজিং পেমেন্ট মডেলের নতুন ধারণা, যেখানে কিছু কাজের ওপর নির্ভর করে পেমেন্ট দেওয়া হয়। সিপিএ মার্কেটিংয়ে পেমেন্ট করা হয় কোনো প্রোডাক্ট সেল করার বিনিময়ে নয়, নির্দিষ্ট একটি কাজের বিনিময়ে। এগুলোকে সহজ ভাষায় অ্যাকশন (অপঃরড়হ) বলে। যেমন- রেজিস্ট্রেশন, ই-মেল সাবমিট, পিন সাবমিট অথবা ডাইনলোড ইত্যাদি। তাই বর্তমানে প্রচলিত অ্যাডভার্টাইজিং পেমেন্ট মডেলগুলোর চেয়ে সিপিএ মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে সহজে কয়েকগুণ বেশি আয় করা সম্ভব। বিষয়টি একটি উদাহরণ দিয়ে আরও পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, কোন একটি সফটওয়্যার কোম্পানি ডাউনলোড অফার দিল যে তাদের সফটওয়্যার ডাউনলোড করিয়ে দিতে পারলে পার ডাউনলোড ২ ডলার পেমেন্ট দেওয়া হবে। এখন আপনি যদি একটি সফটওয়্যার ডাউনলোড করিয়ে দিতে পারেন তাহলে পার ডাউনলোড এ পাবেন ২ ডলার করে। এইটাই হচ্ছে সিপিএ মার্কেটিং। সুতরাং অনলাইনে ইনকাম করার যেসব পদ্ধতি আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সহজ এবং সেরা একটি উপায় হলো সিপিএ মার্কেটিং। কিন্তু সিপিএ মার্কেটিং কোনো ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং নয়। বরং অনলাইনে ইনকাম করার যেসব পদ্ধতি আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সহজ এবং সেরা একটি উপায় হলো সিপিএ মার্কেটিং।
সিপিএ মার্কেটিং সফল করার কতিপয় উপায়
১. ডাটা সংগ্রহ ও পরিচিতি তৈরি: সিপিএ মার্কেটিংয়ের প্রাথমিক ধাপ হলো কাস্টমারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং তাদের ডাটা যেমন: নাম, ঠিকানা, ই-মেল, ফোন নম্বর ইত্যাদি সংগ্রহ করা। ২. কাস্টমার প্রোফাইল তৈরি: সংগৃহীত ডাটা ব্যবহার করে প্রতিটি কাস্টমারের জন্য একটি প্রোফাইল তৈরি করা। এই প্রোফাইল কাস্টমারের সঞ্চয়, আগ্রহ, পছন্দ ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কিত থাকতে সাহায্য করবে। ৩. প্রকাশ্য প্রেফারেন্স শনাক্ত করুন: কাস্টমারের পছন্দ, আগ্রহ এবং নীতি সম্পর্কে জানা, যাতে তাদের পছন্দনীয় পণ্য বা সেবায় সর্ববেশি আকর্ষণ করা যায়। ৪. ব্যবহারকারীর সঙ্গে সাপোর্ট স্থাপন: কাস্টমারদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সাপোর্ট মেকানিজম স্থাপন করা, যাতে তাদের যে কোনো প্রশ্ন, সমস্যা বা আবশ্যকতা থাকলে সেগুলো সমাধান করতে সাহায্য হয়। ৫. প্রস্তাবনা এবং ডিসকাউন্ট প্রদান: কাস্টমারদের কোনো প্রস্তাবনা, ডিসকাউন্ট বা বিশেষ অফার দেওয়া একটি ভালো উপায় যা তাদের আকর্ষণ করতে পারে এবং উন্নতিকরণ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। ৬. ব্যক্তিগত যোগাযোগ প্রদান: কাস্টমারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ আপনার প্রোডাক্টস সম্পর্কে তাদের আরও বেশি জানার সুযোগ দেওয়া। ৭. পর্যায়ক্রম এবং আপডেট প্রদান : নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ করতে, আপডেট প্রদান করতে বা ব্র্যান্ড সংক্রান্ত আরও তথ্য প্রদান করতে ব্যবহারকারীদের জানতে দেওয়া। ৮. ফিডব্যাক গ্রহণ ও সম্পর্ক উন্নতি: কাস্টমারদের থেকে ফিডব্যাক গ্রহণ করা, তাদের প্রতিটি মতামত আমলে নিয়ে ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া উন্নত করতে সাহায্য করা। ৯. সংলগ্ন কাস্টমারদের জন্য আকর্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি: উপযুক্ত এবং আকর্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি করা, যা তাদের আকর্ষণ ও উৎসাহিত করে। ১০. দ্বারা নির্দেশিত উন্নতি: কাস্টমাররা যাতে দীর্ঘদিন ধারাবাহিকভাবে সংযোগ থাকতে পারে, সেই বিবেচনায় তাদের বয়স, লিঙ্গ, আগ্রহ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করে কনটেন্ট আপলোড বা ডাউনলোড করা।উপরোক্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার জন্য এবং সিপিএ মার্কেটিংয়ে বেশি লিড আনার জন্য এমন একটি প্ল্যাটফর্মের সংযুক্ত থাকা উচিত যেখানে লাখ লাখ দর্শক রয়েছে। যেমন- ১. সামাজিক মাধ্যম : এটি বিনামূল্যে মার্কেটিং করার একটি স্বাভাবিক উপায়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, টিকটক, পিন্টারেস্ট, লিংকডইন ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে টার্গেট অডিয়েন্সকে খুঁজে বের করে অফার শেয়ার করা যায়। ২. ডিজিটাল বিজ্ঞাপন : আরেকটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম। গুগল অ্যাডস, ফেসবুক অ্যাডস এবং অন্যান্য ডিজিটাল বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্মে অফার প্রচার করা যায়। ৩. বøগ : বøগ লেখা একটি উপায় যা ওয়েবসাইটের ট্রাফিক বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। নির্দিষ্ট কিওয়ার্ড সম্পর্কে বøগ লেখার মাধ্যমে ওয়েবসাইটকে সার্চ ইঞ্জিন অ্যাপ্রোচ করা যায়। ৪. ই-মেল মার্কেটিং : ই-মেল মার্কেটিং একটি প্রভাবশালী উপায় যা সংগ্রহকারীদের সঙ্গে পরিচয় তৈরি করার জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম। ৫. ভিডিও মার্কেটিং : ভিডিও মার্কেটিং আধুনিক সময়ে একটি স্বাভাবিক পদ্ধতি যা বিনামূল্যে মার্কেটিং করা যায়। ৬. কনটেন্ট মার্কেটিং : গেস্ট পোস্টিং, ইনফোগ্রাফিক, ইবুক ইত্যাদির মাধ্যমে অফার প্রমোট করা। বøগ পোস্ট, পণ্য বিবরণ, অ্যাফিলিয়েট বøগ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, সবই তৈরি করা যায় এই মাধ্যমে।
সিপিএ মার্কেটিংয়ের নির্ধারিত কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিভিন্ন কোম্পানির ই-মেল সাবমিশন করানো, অ্যাপ্লিকেশন করা, সফটওয়্যার অথবা কোনো গেম ডাউনলোড করানো, ফর্ম ফিল-আপ করানো, ফর্ম রেজিস্ট্রেশন করানো, সার্ভে জমা দেওয়া, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সাইন আপ করা, কল অফার করা ইত্যাদি। এছাড়াও ফাইন্যান্সিয়াল, ক্যাজুয়াল, মোবাইল অ্যাপস, ট্রাভেল, ই-কমার্স, স্বাস্থ্য সহায়ক ইত্যাদি বিষয়গুলোও আছে। বিশ্বে প্রায় ৫০০-এর ওপর সিপিএ মার্কেটপ্লেস রয়েছে। সবচেয়ে বড় সিপিএ নেটওয়ার্কগুলো হল গধীনড়ঁহঃু, চববৎভষু, ঘবাবৎনষঁব, ধভভরষরধীব, অ৪উ, ঈষরপশনড়ড়ঃয, ঈষরপশফবধষবৎ ইত্যাদি। এগুলোর অ্যাকশন রেট অনেক বেশি এবং অ্যাকাউন্ট পাওয়া অনেক কঠিন। তবে নতুনদের জন্য সবচেয়ে ভালো কিছু সিপিএ নেটওয়ার্ক হলো : অফড়িৎশসবফরধ, ঈঢ়ধষবধফ, ঈঢ়ধমৎরঢ়, অফংপবহফসবফরধ ইত্যাদি। ফ্রি ট্রাফিকের মাধ্যমে সিপিএ মার্কেটিংয়ে সফল হওয়া সম্ভব, তবে এটি সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন কাজ। সেজন্য পেইড ট্রাফিকের দিকেই ঝুঁকতে হয়। তবে সিপিএ মার্কেটিংয়ের কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। যেমনÑ তীব্র প্রতিযোগিতা ও ট্রাফিক তৈরি করা- জনপ্রিয় নেটওয়ার্কে নতুনদের জন্য রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং সঠিক ট্রাফিক সোর্স খুঁজে পাওয়া কঠিন হতে পারে। পরিশেষে, সিপিএ মার্কেটিং একটি অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং মডেল, যেখানে প্রকাশক বা মার্কেটার নির্দিষ্ট একটি কাজ (যেমন- সাইন আপ, ফর্ম পূরণ, অ্যাপ ডাউনলোড ইত্যাদি) সম্পন্ন করার জন্য কমিশন উপার্জন করে। এটি সহজ, ঝুঁকিমুক্ত এবং নতুনদের জন্য একটি আদর্শ অনলাইন ইনকামের মাধ্যম। সঠিক নেটওয়ার্ক নির্বাচন, কৌশলগত পরিকল্পনা এবং ধৈর্য ধরে কাজ করলে এটি হতে পারে স্থায়ী আয়ের প্রধান উৎস।
লেখক : অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়