
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গণমাধ্যমের পাতা উল্টোলেই পরতে পরতে চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি ধর্ষণ ও মব জাস্টিস যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিটি গ্রাম পাড়া ও মহল্লায় ডজন খানিক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা এসব অপকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেকে আবার সালিশ দরবারের নামে অবিচার করাকে রোজগারের উৎস বানিয়ে নিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছেড়ে দে মা কাইন্দা বাঁচি নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে আবার সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বোল পাল্টিয়ে স্বভাব সুলভ অপরাধ করে বেড়াচ্ছেন। কেউবা নতুন দলবাজি ও চাটুকারিতা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কতক আবার বিভিন্ন উপলক্ষকে সামনে রেখে মন মত ট্যাগ লাগিয়ে লুটতরাজে নেমেছেন। এসব অনাচারে বৈধতা দিতে গিয়ে কেউবা বলছেন, এদেশের মানুষ গরিব তাই এসব করছেন, দারিদ্র সীমার নিচে থাকায় এসব করতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব অপরাধ বিকলাঙ্গ কানা বধির বা অন্য কোনো কারণে কাজ করতে অক্ষম ব্যক্তি করছেন না, কর্মক্ষম ব্যক্তি করছেন। তবে কেন এমন মন্দ কাজ? কেন এ মিছে অভিনয়?
বর্তমান বাংলাদেশে এক বা একাধিক দিন উপোস একজন ব্যক্তিও কি পাওয়া যাবে? নিশ্চয়ই না। তবে কি এহেন মন্দ কাজের বৈধতা আছে? এ হক কথাটি বলার লোকের ও বড্ড অভাব। একটি গান আমার মনে পড়ল, দয়ালবাবা কলা খাবা গাছ লাগাইয়া খাও, পরের গাছে পানে কেন মিট মিটাইয়া চাওরে বাবা। বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা যে পরিমাণ খাবার অপচয় করছি, একটা সময় এতটা খাবার জোগাড় করতে ও পারত না। বাংলাদেশে এক শ্রেণীর লোক রয়েছেন যারা কোন উপার্জন করার চেষ্টা করেন না, এমনকি অপচয়ও বেশি করে থাকেন। আমার মনে পড়লো দক্ষিণ আফ্রিকার ফটোগ্রাফার কেবিন কার্টারের সেই পৃথিবী কাঁপানো ছবিটির কথা। যা তোলার পর ফটোগ্রাফার নিজেই নিজেকে শেষ করেছিলেন! ছবিতে একটি শকুন বসে আছে কঙ্কালসার এক শিশুর মৃত্যুর অপেক্ষায়, যেন মারা গেলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে লক্ষ্যবস্তুর উপর! ১৯৯৩ সালের মার্চ মাস। দুর্ভিক্ষ পীড়িত সুদান। কোথাও একফোঁটা দানা নেই। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর শিশুটি এক মুঠো খাবারের সন্ধানে আয়োদ শহর থেকে আধা মাইল দূরে জাতিসংঘের খাদ্য গুদামের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এক পর্যায়ে সে তার মৃতপ্রায় নিথর দেহটি নিয়ে উবু হয়ে মাটিতে মাথা রেখে বসে পড়ে। ঠিক তখনই একটা শকুন এসে লোলুপ দৃষ্টি হেনে শিশুটির মাংস ভক্ষণ করার জন্য প্রতীক্ষা করতে থাকে।
এই ছবি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এ প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ১৯৯৪ সালে সেরা ফিচার ফটোগ্রাফির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নেয় ছবিটি। কিন্তু ফটোগ্রাফার কেভিন কার্টার পুরস্কার জেতার ৪ মাসের মাথায় মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নিজেই নিজেকে শেষ করে বসেন। পরে জানা যায়, ছবিটি তোলার পর থেকেই তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন! মৃত্যুর আগে ছবিটির বিষয়ে কেভিন কার্টার তার ডায়রিতে লিখেছিলেন ‘হে পরম করুণাময়, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি কোনও খাবার, তা সে যত খারাপ স্বাদেরই হোক না কেন আমি সেটা নষ্ট করব না, এমনকি আমার পেটে ক্ষুধা না থাকলেও না! আমি প্রার্থনা করি, আমরা চারপাশের পৃথিবীর প্রতি আরো সংবেদনশীল হব এবং আমরা আমাদের ভেতরের স্বার্থপরতা এবং সংকীর্ণতা দ্বারা অন্ধ হয়ে যাব না। আমি আরো প্রার্থনা করি, তুমি ওই ছোট্ট ছেলেটিকে রক্ষা করবে, পথ দেখাবে আর ওকে ওর দুঃখ থেকে মুক্তি দেবে। এই ছবি যেন মানুষকে মনে করিয়ে দেয় ওই শিশুটির তুলনায় তারা কতটা ভাগ্যবান, কারণ তোমার করুণা ছাড়া কারো ভাগ্যে একটি দানাও জোটে না। বিদায়!
এখন আমরা যদি আমাদের বর্তমান অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভেবে দেখি। আজ থেকে ২০০ বছর পর আমার বাড়িতে, আমার ঘরে যারা বসবাস করবে, যারা আমার জায়গা জমি ভোগ করবে আমি তাদের চিনিনা। তারাও আমাকে চিনবে না। কারণ তাদের জন্মের অনেক আগেই আমি কবরবাসি হয়ে যাব। আর ততদিন মুছে যাবে আমার নাম নিশানা। কবরটাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমার সন্তানরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তারা হয়ত মনে পড়লে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলবে! প্রায় ২০০ বছর আগে মারা গেছে আমার দাদার দাদা। যিনি আমার পূর্ব পুরুষদের জন্য ঘর বাড়ি, জায়গা জমি রেখে গেছেন। একিই বাড়ি, একিই জায়গা জমি আমরা এখন ভোগ করছি। কিন্তু উনার কবরটা কোথায় সেটা আমরা জানি না। হয়ত আমার দাদার পিতা জানতেন। কিন্তু দাদার পিতা তো বেঁচে নেই, দাদাও বেঁচে নেই। তবে সাত পাঁচ করে যে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সেটা কবরে নিয়ে যেতে পারবেন না। আর যাদের জন্য রেখে যাচ্ছেন তারা ও আপনাকে মনে রাখবে না এটা নিশ্চিত! অন্যের সম্পত্তি জবর দখল করে ভাবছেন আপনি জিতে গেছেন? ঘুষ, কমিশন বাণিজ্য করে সম্পদের পাহাড় গড়ে গেছেন? তাহলে আপনি আস্ত একটা বোকা! আমাদের সময় খুব কম! তাই এই ঘুষ, দুর্নীতি ক্ষমতার অপব্যবহার, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, কোন লাভ নেই।
পৃথিবী আমার স্থায়ী ঠিকানা নয়
মৃত্যু একদিন মুছে দেবে সকল রঙ্গিন পরিচয়
মিথ্যে অধিকাংশ মানুষের বন্ধন
মিথ্যে অধিকাংশ মায়া স্নেহ প্রীতি ক্রন্দন।
মিথ্যে এই জীবনের রংধনুর সাত রং
মিথ্যে এই দুদিনের অভিনয়
মিথ্যে এই ক্ষমতার দন্ধ।।
মিথ্যে অধিকাংশ গান কবিতার ছন্দ
মিথ্যে এই অভিনয় নাটকের মঞ্চ
মিথ্যে এই জয় আর পরাজয়
পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়
মরণ একদিন মুছে দেবে সকল রঙ্গিন পরিচয়।
তবে কেন এ দাম্ভিকতা। কেন বৈষম্যের শীর্ষে আরহন। কেন লঘু পাপে গুরু দন্ড। মনে পড়ল এ তো সেদিনকার কথা, এ জাতির এখনো মগজে গেঁথে আছে, কয়েকটি কথা ফেসবুকে পোস্ট করার দায় একজন নারী কর্মজীবীকে সাত ধরনের শাস্তি প্রদান। যদিও প্রকাশ্য দিবালোকে খুনিরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আসুন আমরা মিছে অভিনয় পরিহার করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ বাংলাকে বাসযোগ্য গড়ে তুলি। অকর্ম জীবন নয়, পরিশ্রম নির্ভর জীবন গড়ি। চেটে নয়, খেটে খাই। আজ হতে শপথ গ্রহণ করি, আর কখনো খাবার অপচয় করব না।
লেখক: ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
মুহাম্মদ ওমর ফারুক