ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর

লুটেরাদের জব্দকৃত সম্পদ দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করবে সরকার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:২১, ২০ মে ২০২৫

লুটেরাদের জব্দকৃত সম্পদ দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করবে সরকার

গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ব্যাংক ও অন্যান্য খাত থেকে যে অর্থ লুট হয়েছে তা সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে। লুটেরাদের পাচারকৃত অর্থ ও ব্যাংকের জব্দ শেয়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়া আইনি কাঠামোর মধ্যে সম্পন্ন হবে। লুটের টাকা সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয়ে ‘ব্যবস্থাপনা তহবিল’ গঠন করবে সরকার। 
এর আগে সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে লুটপাট হওয়া সম্পদ ও অর্থ পুনরুদ্ধারের পর সেই সম্পদ কিভাবে কোন খাতে ব্যয় করা হবে সেই লক্ষ্যে একটি তহবিল গঠনের নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম।  
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আদালতের সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনে আইন সংশোধনের মাধ্যমে ফান্ড গঠন করা হবে। ব্যাংক ক্ষতিপূরণ এবং জনহিতকর কাজে ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের ফান্ড গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। 
এক প্রশ্নে আহসান এইচ মনসুর বলেন,  জব্দকৃত সম্পদের হিসাব কোর্টের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেই এবং আইনের সঠিক ধারা প্রয়োগের মাধ্যমেই এই কার্যকলাপ করা হবে। প্রয়োজনে আইন কিছু সংশোধন করতে হতে পারে। এটা নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় কাজ করবে। যদি এটি প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া বর্তমান আইন দিয়ে যদি এটি করা সম্ভব হয় তাহলে আমরা সেটাই করব।
গভর্নর বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটা ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা। যেটার অর্থ দিয়ে আমরা ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে পারব। কারণ ব্যাংকগুলো বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের টাকা তো লুট করা হয়েছে। এছাড়া বাকি টাকা যেগুলো নন ব্যাংক রিলেটেড, যেগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা অর্জন করা হয়েছে, সেগুলো সরকার আরেকটা ফান্ডে নিয়ে জনহিতকর কাজে ব্যয় করবে। সবই আইনগতভাবে করা হবে। কোনোটাই আইনের বাইরে হবে না। 
গভর্নর বলেন, আমি আগেও বলেছি যারা টাকা পাচার করেছে তাদের কিন্তু আমরা শন্তিতে থাকতে দেব না। পাচারকারীরা বিপুল অর্থের বিনিময়ে আইনজীবী নিয়োগ দিচ্ছে। এতেই বোঝা যায় তারা দৌড় ঝাঁপের ওপর আছে। শান্তিতে নেই। যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর সরকারের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। বিদেশীদের কাছ থেকে আমরা প্রচুর আগ্রহ পাচ্ছি।  তারা জানিয়েছে আমরা যথাযথ প্রমাণ দিতে পারলেই টাকা ফেরত দেওয়া হবে। 
প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ‘তারা শান্তিতে যে নেই, এর আরও একটা প্রতিচ্ছবি হলো, মাঝারি আকারের আরও ১২৫টি অনিয়ম তদন্তের আওতায় আসছে, যারা ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ লুট করেছেন। আমরা ২০টি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছি। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কী কাজ হবে, তার কার্যপরিধি ঠিক করা হচ্ছে।’
প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, যারা তদন্তের আওতায় এসেছেন, তাদের ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার বিদেশে ও ৪২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
গভর্নর আরও বলেন, এমএফএস কোম্পানি নগদের আগের বোর্ডে যারা ছিলেন তারা বিপুল আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। নগদের আইটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুষ্কৃতকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সব ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে এই মুহূর্তে কি হচ্ছে তা নিয়ে শঙ্কিত বাংলাদেশ ব্যাংক। বিগত সময়ের মতো অর্থ তছরুপ ও বেআইনি কর্মকা- হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। 
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার নগদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। প্রশাসক বসানোর পর নিরীক্ষায় উঠে আসে, নগদ লিমিটেডে বড় ধরনের জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না। 
সাবেক সরকারের আমলে নিয়মের বাইরে গিয়ে গ্রাহক বানানো ও সরকারি ভাতা বিতরণসহ একচেটিয়া সুবিধা পায় নগদ। প্রতিষ্ঠানটিতে যখন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। সবার চোখের সামনে এসব অনিয়ম হয়। এ ঘটনায় সরকারের ডাক বিভাগের আটজন সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি), নগদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (সিইও) ২৪ জনকে আসামি করে মামলা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের বড় ১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে আন্তসংস্থা টাস্কফোর্সের আওতাধীন ১১টি টিম। এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য বৈঠকে তুলে ধরা হয়। শেখ হাসিনার পরিবারের বাইরে যে ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপ।

×