ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শতবর্ষী ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন

ইতিহাস ঐতিহ্য ও অর্থনীতির স্পন্দন, কালের বিবর্তনে এখনো অমলিন

তৌহিদ আক্তার পান্না

প্রকাশিত: ০০:৪৮, ২০ মে ২০২৫

ইতিহাস ঐতিহ্য ও অর্থনীতির স্পন্দন, কালের বিবর্তনে এখনো অমলিন

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঈশ্বরদী  রেলওয়ে জংশন

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন। প্রায় সোয়াশ’ বর্ষের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই স্টেশন শুধু একটি গমনাগমনের কেন্দ্র নয়, এটি একটি অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অর্থনীতির স্পন্দন। পাবনা জেলার ঈশ^রদীর এই গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশনটি আজও ধারণ করে আছে ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যশৈলী, যা কালের বিবর্তন এখনো অমলিন। 
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, উনিশ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ সরকার যখন বাংলায় রেলপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়, তখন ঈশ্বরদীর ভৌগোলিক গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। উত্তরাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই জংশন স্টেশনটি স্থাপিত হয়।

ধারণা করা হয়, ১৯১৫ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে এই স্টেশনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। পাট, ধান, গমসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য পরিবহনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনটি।

ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের দিক দিয়ে লক্ষ্য করা যায়, ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের মূলভবনটি আজও তার পুরনো স্থাপত্যশৈলী ধরে রেখেছে। লাল ইটের গাঁথুনি, উঁচু খিলানযুক্ত দরজা-জানালা এবং সুদীর্ঘ প্ল্যাটফর্মগুলো সেই সময়ের নির্মাণশৈলীর পরিচয় বহন করে। যদিও সম্প্রতি প্ল্যাটফরম ৪টি যাত্রীদের সুবিধার্থে উঁচু করায় কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

স্টেশনের ভেতরের পুরনো টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিংরুম এবং কর্মকর্তাদের কক্ষগুলোতে এখনও সেই আমলের নীরব সাক্ষী। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব দর্শক এই স্টেশন, যাকালের স্রোতে বহু মানুষের মিলন ও বিচ্ছেদের সাক্ষী হয়ে আছে। 
দেশের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিাণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার বলেখ্যাত ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন একটি ব্যস্ততম স্টেশন। প্রতিদিন বহু ট্রেন এখানে যাত্রাবিরতি করে। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার যাত্রীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনের কিছু অংশে জীর্ণতা দেখা দিয়েছে। প্ল্যাটফর্মের ছাউনি, বিশ্রামাগার এবং অন্যান্য যাত্রী সুবিধাগুলোর আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। জনবল সংকট এবং কিছু ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার অভিযোগও রয়েছে।
সম্ভাবনার দিক থেকে বিবেচনা করা হলে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এটিকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন একটি স্মার্ট স্টেশনে উন্নীত করা গেলে যাত্রীসেবার মান বহুলাংশে বাড়বে। একই সঙ্গে আর্থিক সম্ভাবনার বিষয়টিও বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন। 
ইতিহাস ঐতিহ্যের দিক থেকে স্টেশনটিকে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মের সংস্কার, ডিজিটাল তথ্য ব্যবস্থা স্থাপন, আধুনিক বিশ্রামাগার, উন্নত টয়লেট ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা জরুরি। 
ঈশ্বরদীকে একটি মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। রেলের পাশাপাশি সড়ক পথের সঙ্গে উন্নতসংযোগ স্থাপন করে পণ্য পরিবহনকে আরও সহজতর করা যেতে পারে। এটি করা সম্ভব হলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং এর গুরুত্ব তুলে ধরে পর্যটকদের আকর্ষণ করা যেতে পারে। স্টেশনের ইতিহাস নিয়ে একটি ছোট জাদুঘর স্থাপন করা যেতে পারে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলতো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি, সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এমনকি বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও পদচারণার ইতিহাস রয়েছে এই স্টেশনে।
ঈশ^রদী স্টেশনকে কেন্দ্র করে স্টেশনের আশপাশে আধুনিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে আরও গতি সঞ্চার করতে পারে।
স্থানীয়দের প্রত্যাশা, ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন শুধু একটি স্টেশন নয়, এটি স্থানীয় মানুষের আবেগ ও ঐতিহ্যের অংশ। স্থানীয় বাসিন্দারা এই স্টেশনের আধুনিকীকরণ এবং যাত্রীসেবার মানোন্নয়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছেন। তাদের প্রত্যাশা, কর্তৃপক্ষ এই ঐতিহ্যবাহী স্টেশনের গুরুত্ব অনুধাবন করে এটিকে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী স্টেশনে রূপান্তরিত করবে।
সোয়াশ’ বর্ষের এই ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে জংশন স্টেশনটিকে ঘিরে ট্রেন সংখ্যাবৃদ্ধি, চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন এবং সঠিকভাবে পরিচর্যা ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে শুধু যাত্রীসেবার মানই বাড়ানো সম্ভব নয়, বরং এটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি এবং যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমেই ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন তার অতীত গৌরব ধরে রেখে ভবিষ্যতের দিকে আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারবে, এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।

×