
ছবি: জনকণ্ঠ
মানুষের নানা রকম নেশা থাকে। কেউ গান করেন, কেউ বাগান করেন, কেউ ভ্রমণ ভালোবাসেন। কিন্তু এমন একজন মানুষও আছেন, যাঁর নেশা হলো কবর খোঁড়া। মৃত্যু সংবাদ পেলেই হাতে নেন দা, কুড়াল, খুন্তি প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম, তারপর ছুটে যান দাফনের কাজে। বিনা পারিশ্রমিকে নিপুণ হাতে খুঁড়ে দেন মানুষের শেষ আশ্রয় কবর। তিনি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের মোল্লাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা, ৮০ বছর বয়সী নোরা মিয়া।
গত কয়েক দশকে নোরা মিয়া নিজ হাতে খুঁড়েছেন দুই শতাধিক কবর। একবার নয়, বহুবার যে কোনো এলাকায়, যে কোনো সময় কেউ মারা গেলে, খবর পেয়েই হাজির হন। তাঁর হাতে কবর খোঁড়া মানে পরিবারটির জন্য এক ধরনের নিশ্চয়তা দাফনের পুরো কাজ যেন পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে।
“এটাই আমার শান্তি” নোরা মিয়া বলেন, “কারও মৃত্যুর খবর পেলে আর বসে থাকতে পারি না। কোনো কাজের মাঝেও থাকলে সেটা ফেলে রেখে ছুটে যাই। এটা যেন আমার নেশা, আবার শান্তিরও জায়গা।”
কখনও খাওয়ার সময় হঠাৎ মৃত্যু সংবাদ এলে ভাত রেখে চলে যান। তাঁর ভাষায়, “মানুষের জন্য কিছু করতে পারা এটাই তো সবচেয়ে বড় কাজ।” শুধু কবর খোঁড়া নয়, প্রয়োজনে বাঁশ কেটে কবরের বেড়া তৈরি করা, দাফনের অন্যান্য কাজও নিজের হাতে করেন।
পরিবারের সহযোগিতা: নোরা মিয়ার এই ব্যতিক্রমী কাজের পথে তাঁর পরিবার কখনোই বাধা দেয়নি। বরং তাঁর ছেলে ও নাতিরাও অনেক সময় দাফনের কাজে তাঁকে সহায়তা করে। নোরা মিয়া বলেন, “ছেলেরা বলে, ‘বাবা, যা ভালো বুঝে করো।’ আমি কখনও টাকার জন্য করিনি। মানুষ শুধু দোয়া করলেই আমার তৃপ্তি।”
মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা: স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, নোরা মিয়ার উপস্থিতি মানেই শেষ বিদায়ের এক মানসিক আশ্বাস। কেউ মারা গেলে প্রথমেই তাঁকেই খবর দেওয়া হয়। কেউ কেউ বলেন, “নোরা ভাই থাকলে অন্তত কবর খোঁড়া নিয়ে ভাবতে হয় না।”
সমাজের জন্য এক দৃষ্টান্ত: নোরা মিয়ার কাজ শুধু একটি শখ নয়, এটি একটি নির্লোভ, সেবাধর্মী জীবনের প্রতিচ্ছবি। যখন সমাজে অর্থ ছাড়া কাজ করার প্রবণতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে, তখন তাঁর মতো মানুষেরা নিঃস্বার্থ মানবিকতার যে আলো ছড়ান, তা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়।
তিনি নিজেই বলেন, “একদিন আমাকেও তো মাটির নিচে যেতে হবে। অন্যের জন্য কবর খুঁড়তে খুঁড়তে আমার নিজেরটার রূপ কেমন হবে, সেটাও যেন ভেবে ফেলি।”
মানুষের জীবনের শেষ কাজটি যিনি ভালোবেসে করেন, তিনি নিঃসন্দেহে সমাজের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নোরা মিয়ার জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়। মানবিকতার কোনো অবসর নেই।
শহীদ