
.
এক সময় সন্ধ্যা হলেই পরিবারের সবাই একসাথে বসে গল্প করত, কোনো মজার ঘটনা শেয়ার করত কিংবা টেলিভিশনের প্রোগ্রাম উপভোগ করত। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল চিঠি, ফোন বা সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে। কিন্তু এখন? ঘরভর্তি মানুষ। কিন্তু সবাই আলাদা জগতেÑ ফোনের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে আছে। এই স্ক্রিনটাই যেন হয়ে উঠেছে নতুন পরিবার, নতুন বন্ধু। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম কিংবা টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের জীবনে বিশাল জায়গা দখল করে নিয়েছে। ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে চোখ কে কী পোস্ট করল, কে কী কমেন্ট করলÑ এসব দেখা এখন দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনেকের তো আবার খাবারের সময়ও হাতের এক পাশে মোবাইল থাকে। এই অভ্যাস শুধু ব্যক্তিগত জীবনকেই নয়, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ককেও ক্ষয় করছে। আজকাল পারিবারিক জমায়েত বা ঈদের মতো উৎসবেও দেখা যায়, কিশোর থেকে শুরু করে প্রৌঢ় পর্যন্ত সবাই মগ্ন থাকে নিজেদের মোবাইলে। ছোটরা অনলাইন গেমে, বড়রা ফেসবুক স্ট্যাটাসে।
ফলে গল্প, হাসিঠাট্টা কিংবা আন্তরিক আলাপ প্রায় হারিয়ে গেছে। বাবা-মা আর সন্তানের মাঝেও অনেক সময় একটা ভার্চুয়াল দেয়াল তৈরি হয়, এর ফলে একে অন্যকে বুঝতে না পারার জন্ম দেয়। শুধু পরিবার নয়, প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের সঙ্গেও সম্পর্কের জায়গায়ও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আগে যেখানে পাড়ার বড়রা ছোটদের খোঁজ খবর নিতেন, এখন সেই জায়গাটা অনেকটাই ফাঁকা। বিকেলের খেলার মাঠ আর মুখরিত প্রান্তর হয় না। জমে উঠে না ফুটবল-ক্রিকেট নিয়ে উচ্ছ¡াস। মানুষ এখন ভার্চুয়ালি হাজারজন ‘ফ্রেন্ড’ রাখে। কিন্তু বাস্তবে মনের কথা বলার মত একজনও অনেকের থাকে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে একটা প্রায় অসুস্থ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের একাংশ ডুবে থাকে হতাশায়, রাতভর ফোনে স্ক্রোলিং শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিকর। তাই প্রযুক্তির ব্যবহারে চাই নিয়মানুবর্তিতা। সময় এসেছে ভাবার এই প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, নাকি আমরা প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি? ইন্টারনেট আমাদের অগ্রগতির হাতিয়ার। কিন্তু সেটির সঠিক ব্যবহার না হলে তা আমাদের একাকিত্ব আর সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রয়োজন পরিবারে সময় কাটানোকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ‘স্ক্রিন টাইম’ কমিয়ে ‘ফ্যামিলি টাইম’ বাড়ানো দরকার। একসাথে খাওয়ার সময় মোবাইল দূরে রাখা, সপ্তাহে অন্তত একদিন পারিবারিক আড্ডার আয়োজন করা, সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করার অভ্যাস গড়া এসব ছোট ছোট উদ্যোগই বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এছাড়াও সন্তানের হাতে ফোন নয় বই তুলে দিন। তাদের কাজে উৎসাহিত করতে বই উপহার দিন।বছরের কিছু সময় কাটিয়ে আসুন প্রকৃতির ভিড়ে ভ্রমণে। নিয়মিত পরিবারে দেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন, এতে শিশু-কিশোরের জ্ঞানের বিকাশ ঘটবে।
সবশেষে, মনে রাখতে হবে ইন্টারনেট আমাদের সময় কেড়ে নিচ্ছে। ফেসবুকের লাইক-কমেন্ট নয়, বরং পরিবারের হাসি, বন্ধুর কাঁধ, প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যাওয়া কিংবা কারো আন্তরিক আলাপনই আমাদের মনকে সত্যিকারের প্রশান্তি দিতে পারে।