
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ছয়টি ঋতুই প্রকৃতিতে আসে আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য নিয়ে। প্রতিটি ঋতুতেই নররূপে সজ্জিত হয় বাংলার মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর ও প্রকৃতি। অন্যান্য ঋতুর মতো শীতকালেরও রয়েছে এর নিজস্ব কিছু সৌন্দর্য, বৈশিষ্ট ও ঐতিহ্য। বাংলায় পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল। তবে হেমন্তের শেষের দিকেই বাংলার বুকে শীতের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। ভোর রাতে টিনের চালে শিশিরের শব্দে ঘুম ভাঙ্গা থেকে শুরু করে সকাল-সাঝে কুয়াশাঘেরা প্রকৃতি মুগ্ধ করে বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে। এছাড়াও শীতকালের অন্যতম সৌন্দর্য্য ও ঐতিহ্য হলো খেজুরের রস সংগ্রহ। তবে কালের পরিক্রমায় বাংলা ও বাঙ্গালীর হাজার বছরের এই ঐতিহ্য আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।
বাংলার বুকে শীতকাল পদার্পণ করতে না করতেই সকাল-বিকাল দা ও মাটির হাঁড়ি হাতে খেজুর গাছের পানে ছোটেন গাছিরা। শীতকালের যে বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য ঋতুতে পাওয়া যায় না তার মধ্যে খেজুরের রস সংগ্রহ অন্যতম। কেননা শীতকাল ছাড়া অন্য কোনো ঋতুতে খেজুরের রস তেমন একটা সংগ্রহ করা যায় না। তাই গ্রাম বাংলার গাছিরা সারা বছর যেনো অপেক্ষা করে থাকে এই শীতকালের জন্যই। কবে শীতকাল আসবে এবং খেজুর গাছের টুসটুসে রসে পরিপূর্ন হবে তাদের মাটির হাঁড়ি। কিন্তু কেনো খেজুর গাছ শুধু শীতকালেই রস দেয় তার পেছনে রয়েছে কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। শীতকালে বাংলার ভ‚-প্রকৃতিতে পানির পরিমান তুলনামূলকভাবে কম থাকে। যার ফলে উদ্ভিদক‚ল সূর্যালোকের উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে তার সবুজ পাতায় পর্যাপ্ত পরিমান খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। তাই খেজুর গাছসহ সমগ্র উদ্ভিদক‚ল শীতকালের খাদ্যের জোগান দিতে শীত পূর্ববর্তী বর্ষাকালে যখন প্রকৃতিতে পর্যাপ্ত পরিমান পানি থাকে, তখন তারা অধিক পরিমান পানি ও খাদ্য নিজেদের মধ্যে স্টার্চ রুপে মজুদ করে রাখে। পরবর্তীতে শীতকালে যখন ঠান্ডা পরা শুরু করে তখন খেজুর গাছের শরীর থেকে এক ধরনের বিশেষ এনজাইম নিঃসৃত হয়। আর এই এনজাইম খেজুর গাছের মধ্যে জমিয়ে রাখা অতিরিক্ত স্টার্চকে ভেঙে শুক্রোজে রুপান্তর করে। যেটাকে আমরা চিনি বলে থাকি। এরপর মূলের মাধ্যমে শোষিত পানি সেই চিনির সাথে মিশ্রিত হয়ে তৈরি হয় এক অভ‚তপূর্ব তরল। যেহেতু মূলের মাধ্যমে শোষিত পানি গাছের উপরের দিকে ধাবিত হয় তাই এ সময় খেজুর গাছের উপরের কোনো অংশে ক্ষত থাকলে সেখান থেকে রস চুইয়ে চুইয়ে পরে। এজন্য খেজুর গাছকে ক্ষত বৃক্ষও বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে শীত আসার পূর্বেই আশ্বিন মাসের শেষের দিক থেকে শুরু করে বৈশাখ মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা যায়। তবে শীতকাল অর্থাৎ পৌষ ও মাঘ এই দুটি মাস খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য উত্তম। এই দুই মাসে খেজুরের রস পাওয়া যায় সবথেকে বেশি। তাই এই দুই মাসেই মূলত বাংলার গাছিরা ব্যস্ত সময় পার করে। বেলা পরে যাওয়ার আগ মুহূর্তেই তারা তাদের ধারালো দা দিয়ে যতœ করে খেজুর গাছের উপরের অংশ কেটে মাটির হাঁড়ি বসিয়ে দেয়। হাঁড়ির উপরে খেজুর গাছের মধ্যে লাগানো নল দিয়ে সারারাত টপটপ করে রস পরতে থাকে। কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতিতে ভোরের আলো ফোটার আগেই গাছ থেকে রসে পরিপূর্ন হাঁড়িগুলো নামাতে শুরু করেন গাছিরা। পরবর্তীতে সেই রস জ্বালিয়ে তৈরি করা হয় খাঁটি খেজুরের গুড় ও চিনিসহ বিভিন্ন উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য। এছাড়াও শীতের সকালে নরম রোদে গা এলিয়ে দিয়ে গøাসভর্তি তরতাজা খেজুরের রসে চুমুক দেয়ার জুরি মেলা ভার।
খেজুরের রস সংগ্রহ করা বাংলা ও বাঙ্গালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য। তবে কালের বিবর্তনে এই ঐতিহ্যে আজ অনেকটাই ভাঁটা পরেছে। এখন আর গ্রামে-গঞ্জে ঠিক আগের মতো খেজুরের রস সংগ্রহের দৃশ্য চোখে পরে না। এর অন্যতম কারন বৃক্ষনিধনের ফলে খেজুর গাছের অপর্যাপ্ততা এবং খেজুরের রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণে গাছিদের সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়া। খেজুরের রস হতে উৎপন্ন গুড়, চিনি ও অন্যান্য দ্রব্য দেশে-বিদেশে রপ্তানি করে উল্ল্যেখযোগ্য অর্থ উপার্জিত হলেও তার সিকিভাগও পায় না গাছিরা। ফলে দিন দিন কমতে শুরু করেছে গাছিদের সংখ্যা ও খেজুরের রস সংগ্রহ। খেজুরের রস সংগ্রহ শুধু আমাদের ঐতিহ্যই নয় এটি আমাদের দেশের অর্থনীতিতেও নজরকারা অবদান রাখতে সক্ষম। তাই বাংলার হাজার বছরের এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে গাছিদেরকে সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি বৃক্ষনিধন রোধ করে পর্যাপ্ত পরিমান খেজুর গাছ রোপন করতে হবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ