ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

ফুরিয়ে গেল আরও একটি বছর

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ফুরিয়ে গেল আরও একটি বছর

দিন যায় দিন আসে, মাস যায় মাস আসে, বছর গড়িয়ে আসে বছর। সময় যেন এক প্রবহমান মহাসমুদ্র। কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে আরও একটি বছর। এভাবেই হারিয়ে যেতে থাকবে সময়গুলো। সঙ্গে হারিয়ে যাবে কত সুমধুর স্মৃতি, কত ভালোলাগার মুহূর্ত। কত আপনজনের প্রিয়মুখ। এভাবেই হয়তো একদিন আমিও থাকব না, হারিয়ে যাব। স্মৃতি কেন এত ব্যথা দেয়। কেন ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে? নতুন বছরেও হয়তো আরও অনেক স্মৃতি জমা হবে। কামনা করি স্মৃতিগুলো যেন আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। তবে আমার কিন্তু ঘুরে ফিরে শৈশব-কৈশোরের কথাই বেশি মনে পড়ে। ওই দিনগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি তাড়িয়ে বেড়ায়। আবেগমথিত করে।
মনে আছে, ছোটবেলায় যখন টিনের ঘরে থাকতাম, বৃষ্টি পড়লে কী ভালোই না লাগত, ঝুম বৃষ্টিতে একটা ঐকতান সৃষ্টি হতো। শরীর ও মনে শীতল পরশ বয়ে যেত। স্মৃতি বড়ই এক অদ্ভুত জিনিস। অনেক সময় বড় ঘটনাগুলোও আমরা ভুলে যাই। মনে দাগ কাটে না। আবার সামান্য ঘটনাও মনের মধ্যে থেকে যায়। অনেক ছোট ছোট তুচ্ছ ঘটনাও মনের স্মৃতিকোঠায় জ্বলজ্বল করতে থাকে। চোখ বন্ধ করলেই যেন একটার পর একটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
ছোটবেলায় যখন থেকে গল্পের বই পড়া শুরু করি, তখন থেকেই মনের মধ্যে নানারকম স্বপ্ন বাসা বাঁধতে থাকে। যখন যেটা পড়তাম, সেটাই মনের মধ্যে গেঁথে থাকত। লুকানো বাসনাগুলো মাঝে মধ্যেই প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। জীবনে কত কি যে হতে চেয়েছি তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ইচ্ছেগুলো কিছুদিন ডালপালা বিস্তার করে আবার নিভে যেত। তখন শুরু হতো নতুন করে ভাবনা।
ওই বয়সে গল্পের বই পড়ার জন্য কতই না বকা খেয়েছি। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হতো। কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজ থেকে শুরু করে দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম, নিহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা গল্পÑ কিছুই বাকি থাকেনি। তবে ধীরাজ ভট্টাচার্যের ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ এ আত্মজীবনীমূলক বইটি আমার অনুভূতিকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। নতুন করে ভাবতে শেখায়। আগের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। বইটি পড়ে আমি এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি যে, পারলে মাথিনের কূপ দেখতে যেন তখনই ছুটে যাই টেকনাফ।
কলকাতার অভিনেতা, লেখক ও পুলিশ অফিসার ধীরাজ ভট্টাচার্যের জীবনে ঘটে যাওয়া অ্যাডভেঞ্চার ও অধরা রোমাঞ্চকর প্রেমাখ্যান আমার অবচেতন মনে এক গভীর ছাপ ফেলে দেয়। তখন থেকেই পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধাটা তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। রাজারবাগে পুলিশের যে বীরোচিত ভূমিকা রাখার কথা জেনেছি, তাতে শ্রদ্ধাটা আরও বেড়ে যায়। করোনাকালেও পত্রপত্রিকায় দেখেছি, অনেক পুলিশ সদস্যই তাদের দাপ্তরিক দায়িত্ব প্রতিপালনের পাশাপাশি  মানবিক কাজ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু যখন কোনো পুলিশ সদস্যের বড় ধরনের স্খলনের কথা সামনে আসে, তখন খুব কষ্ট পাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে মাথায় নতুন ভাবনা ভর করল। তখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। কোনো এক ছুটির দিনে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কেওয়াটখালী রেলস্টেশনে রাজ্জাক-শাবানার ‘আগুন’ সিনেমাটির শূটিং চলছিল। তাদের একনজর দেখার জন্য উৎসুক জনতার প্রচণ্ড ভিড়। এই ভিড় ঠেলে বন্ধুদের সঙ্গে আমিও শূটিং দেখি। আর  তখন থেকেই সিনেমার নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। ছোটবেলা থেকেই যে দেখতে-শুনতে ভালো ছিলাম তা বন্ধুদের প্রশংসা শুনেই বুঝতে পারতাম, যা আমাকে নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। ওইসময়  রাজ্জাক-শাবানা ছিল সবচেয়ে প্রিয় জুটি। স্কুল পালিয়ে কত যে সিনেমা দেখেছি, তার হিসেব নেই।
মানুষের সব স্বপ্ন, সব আশা সবসময় পূরণ হয় না। আর পূরণ হয় না বলেই মানুষ বারবার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হলো না। হঠাৎ করে রোড এক্সিডেন্টে বাবার মৃত্যু হয়। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। নায়ক হওয়া তো দূরের কথা, সব স্বপ্নই যেন কর্পূরের মতো উবে যায়। বাস্তবতা যে কত কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করলাম। অনেক কষ্টে পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের হাল ধরার লক্ষ্যে চাকরির সন্ধানে বের হয়ে পড়লাম।
ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছিলেন ‘খরভব রং হড়ঃ ধ নবফ ড়ভ ৎড়ংবং’ যা আমাকে এখনো অনুপ্রেরণা জোগায়। একসঙ্গে  কয়েকটি চাকরি হয়ে গেল। বেশির ভাগই ব্যাংকে। তাই কোনো কিছু আর না ভেবে অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকে ঠাঁই করে নিলাম। এক সময় বিদেশেও (যুক্তরাষ্ট্র) পোস্টিং পেলাম, যা আমার চাকরি জীবনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট ছিল। সর্বশেষ, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেই। পুলিশ অফিসার বা সিনেমার নায়ক হতে পারিনি এটা ঠিক, তবে নিজের ক্যারিয়ারের শীর্ষ পদে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য  মহান আল্লাহ পাকের কাছে হাজারবার শুকরিয়া জানাই।
প্রতিটি মানুষের এগিয়ে চলার গল্প ভিন্ন, সংগ্রামবহুল। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। চলার পথে কতবার হোঁচট খেয়ে যে মুখ থুবড়ে পড়েছি, তার হিসেব নেই। দিন শেষে জীবন সংগ্রামে কতটুকু জয়ী হতে পেরেছি জানি না, তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছি যে, জীবনকে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে হলে আর্থিক স্বাধীনতার বিকল্প নেই।
অতীত আছে বলেই বর্তমান অর্থবহ। প্রতিটি সময় সেকেন্ডের কাঁটা ঘুরে মুহূর্তেই স্থান করে নেয় অতীত। সেই সময়গুলো আমাদের কাছে ধরা দেয় স্মৃতির ভিড়ে। তাই যখনই মন খারাপ হয়, সেই হারানো স্মৃতি, সোনালী অতীত হাতড়ে বেড়াই মন ভালো হয়ে যায়।
মানুষ তো প্রকৃতিরই সন্তান। যে কোনো মানুষের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা বড় অবদান থাকে তার জন্মস্থান ও পারিপার্শ্বিকতার। আমার জীবনেও জন্মস্থানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বেঁধে রেখেছে সারাজীবনের ঋণে। আর তাই আমার একান্তে নিভৃত মনে প্রায়ই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে প্রাণপ্রিয় জন্মস্থানটি।
সোনালী ব্যাংকে চাকরির সুবাদে জীবনের ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে বিশালত্বের স্বাদ পাওয়ার লক্ষ্যে একসময়ে স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমালাম ঠিকই, কিন্তু মন পড়ে থাকল ধুলোবালির শহর, প্রাণের শহর টাঙ্গাইলে। এই শহরের অলিতে-গলিতেই আমার বেড়ে ওঠা। এই শহরই আমার তারুণ্য, আমার শৈশব-কৈশোরকাল। এই শহরই আমার মূল পরিচয়, আমার ঠিকানা। এই শহরেই হয়তো একদিন পাততে হবে আমার শেষ বিছানা।

 লেখক : চেয়ারপার্সন, ব্যুরো বাংলাদেশ

×