ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

পরিবহন নীতি এবং বাংলাদেশের ট্রাফিক সমস্যা: সমাধান কি?

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ১০:২০, ১৮ জুন ২০২৫

পরিবহন নীতি এবং বাংলাদেশের ট্রাফিক সমস্যা: সমাধান কি?

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর। এককালে এশহরে যেখানে গাড়ির গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার, সেখানে এখন তা মাত্র ঘণ্টায় ৪.৮ কিলোমিটার। এই চরম যানজট আমাদের অর্থনীতি, সময় এবং জীবনমানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চের সাম্প্রতিক গবেষণায় বিশ্বের ১,২০০ শহরের মধ্যে ঢাকাকে সবচেয়ে ধীরগতির শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ট্র্যাফিক সমস্যা ঢাকা শহরের নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিদিন শুধু মাত্র যানজটের ফলে প্রায় ৫০ লক্ষ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এই সমস্যার মূল কারণগুলো কী এবং আমাদের পরিবহণ নীতিতে কী ত্রুটি রয়েছে যা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে? আজ আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজব।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) এর একটি রিপোর্ট অনুসারে, কেবল মাত্র ঢাকার যানজটের কারণে বাৎসরিক প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পাশপাশি জ্বালানি অপচয় এবং স্বাস্থ্যগত ব্যয় জড়িত। এছাড়া ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকার যানজট বাৎসরিক প্রায় ১৯,৫৫৫ কোটি টাকা ক্ষতির কারণ। এই সংখ্যাটি দেশের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি এবং রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার এক-চতুর্থাংশের সমান। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল, যানজটের কারণে বাংলাদেশের জিডিপি প্রতি বছর প্রায় ১০% কমে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবহণ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, তবে তা ইতিবাচক দিকে নয়। "আপডেটিং দ্য রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান ফর ঢাকা" (ইউআরএসটিপি) এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা ৩৭% বেড়েছে। কিন্তু এর মধ্যে উদ্বেগজনক বিষয় হল, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবহার প্রায় অর্ধেকেরও বেশী কমেছে। এর বিপরীতে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে: মোটরসাইকেল ব্যবহার ২.৫% থেকে বেড়ে ১৫.৩% এবং প্রাইভেট কার ১৮% থেকে বেড়ে ২৪% হয়েছে।

সরকারি তথ্যমতে, ২০২৪ সালে কেবল মাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় ৮,৫৪৩ জন মারা গেছে এবং ১২,৬০৮ জন আহত হয়েছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা মোট দুর্ঘটনার ৩৬.৬২% ছিল, যাতে ২,৫৭০ জন মারা গেছে। এই পরিসংখ্যানগুলো দেখিয়ে দেয় যে, আমাদের পরিবহণ ব্যবস্থা গুরুতর সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে।

বাংলাদেশে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহণ আইন রয়েছে যা দেশের পরিবহণ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৪ সালের "জাতীয় স্থল পরিবহণ নীতি" এবং ২০১৩ সালের "জাতীয় সমন্বিত বহুমুখী পরিবহণ নীতি" এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সরকার ২০২৫-২০৪৫ সময়কালের জন্য ঢাকার জন্য "আপডেটিং দ্য রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান" (ইউআরএসটিপি) প্রণয়ন করছে। গত দশকে সরকার প্রায় ১৩৫,০০০ কোটি টাকা ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামোগত প্রকল্পে ব্যয় করেছে।

কিন্তু এত বিনিয়োগ সত্ত্বেও, যানজট সমস্যার সমাধান হয়নি। এর বদলে, গাড়ির গড় গতি ২০০৭ সালে ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে ২০২২ সালে মাত্র ৪.৮ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপ অনুসারে, ঢাকা শহরের যাত্রীরা গড়ে প্রতি দুই ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট যানজটে আটকে থাকেন, যা বছরে প্রায় ২৭৬ ঘণ্টার অপচয় ঘটায়।

বিশেষজ্ঞরা ঢাকার যানজটের জন্য বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে পার্কিং নীতি না মানা, সীমিত ও অব্যবহৃত পার্কিং স্থান, মোটরবিহীন ও ধীরগতির যানবাহনের আধিক্য, রাস্তার হকারদের দ্বারা রাস্তা দখল, ফুটপাতের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও বেআইনি দখলদারি। এছাড়া ব্যক্তিগত যানবাহনের উপর অত্যধিক নির্ভরতা এবং রেল-ভিত্তিক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সম্পর্কে সচেতনতার অভাব একটি বড় সমস্যা।

ঢাকা শহরের আয়তনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ অপ্রতুল। একটি আদর্শ শহরে মোট আয়তনের ২৫% রাস্তার জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত, কিন্তু ঢাকায় তা মাত্র ৭-৮% রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৩% পাবলিক ও ভারী যানবাহনের জন্য নির্ধারিত। বিআরটিএ অনুসারে, ঢাকায় ১১০টি রুটে ৭,০৪৩টি বাস ও মিনিবাসের প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৪,৫০০টি চালু আছে যা প্রয়োজনীয় সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ।

এখন প্রশ্ন হল, কীভাবে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি? আমার মতে, সমাধান বহুমুখী হওয়া প্রয়োজন যেটি হবে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই।

প্রথমত, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বাসগুলোকে আধুনিক, আরামদায়ক ও নির্ভরযোগ্য করতে হবে। পরিষেবার মানের উন্নতি না হওয়া এবং নতুন বিনিয়োগের অভাবে বর্তমানে ঢাকার বাসগুলোর জনপ্রিয়তা ক্রমাগত কমছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একসাথে কাজ করে বাস পরিষেবার মান উন্নত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মেট্রোরেলকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। বর্তমানে ঢাকা মেট্রোরেল দৈনিক প্রায় ৩ লক্ষ যাত্রী পরিবহণ করে, কিন্তু এটি সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করে শহরের বিভিন্ন অংশকে সংযুক্ত করা প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেখানে দুটি প্রাইভেট গাড়ি মাত্র ছয় থেকে সাতজন যাত্রী পরিবহণ করে একই পরিমাণ রাস্তার স্থান দখল করে একটি বাস কমপক্ষে ৪০ জন যাত্রী পরিবহণ করে। ব্যক্তিগত যানবাহনের উপর কর বাড়ানো, পার্কিং ফি বাড়ানো এবং শহরের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় ব্যক্তিগত যানবাহন নিষিদ্ধ করার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।

চতুর্থত, পথচারীদের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ডিএপি) ২০২২-৩৫ অনুসারে, গড়ে ২০,০০০ টাকার কম আয়ের পরিবারে ৬০% যাত্রা পায়ে হেঁটে সম্পন্ন হয়। সুতরাং, পথচলাচল নিশ্চিত করতে ফুটপাতের উন্নতি ও বেআইনি দখলদারি থেকে মুক্ত রাখা নিশ্চিত করতে হবে।

পঞ্চমত, নগর পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে। ঢাকাকে একটি বহুকেন্দ্রিক শহরে পরিণত করতে হবে, যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলে সব ধরনের পরিষেবা পাওয়া যাবে। এতে মানুষের দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমবে।

ষষ্ঠত, ট্র্যাফিক আইনের প্রয়োগ জোরদার করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত পার্কিং, লেন না মেনে যানবাহন চালানো, ট্র্যাফিক সিগন্যাল না মানা ইত্যাদি যানজটের প্রধান কারণ। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সপ্তমত, পরিবহণ খাতে নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একটি সমন্বিত কর্তৃপক্ষ গঠন করে সকল পরিবহণ সংস্থার কার্যক্রম সমন্বয় করা প্রয়োজন।

অষ্টমত, পরিবেশবান্ধব পরিবহণ ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করতে হবে। ইলেকট্রিক বাসের প্রচলন, স্বল্প দূরত্ব পাড়ি দিতে বাই-সাইকেল ব্যবহার ইত্যাদি বিকল্প পরিবহণ মাধ্যমকে উৎসাহিত করতে হবে।

সর্বোপরি, বাংলাদেশের পরিবহণ নীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। এখন পর্যন্ত, সরকার মূলত অবকাঠামো নির্মাণে মনোযোগ দিয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেগুলো যথাযথ পরিকল্পনা ও সমন্বয় ছাড়া বাস্তবায়িত হয়েছে। পরিবহণ ব্যবস্থাকে সমগ্র জনগণের জন্য অধিকতর সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য করে গড়ে তোলা এবং টেকসই পরিবহণ ব্যবস্থা তৈরি করার লক্ষ্যে সরকারের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। 

পরিশেষে বলতে চাই, পরিবহণ নীতির পুনর্গঠন ও সঠিক বাস্তবায়ন ছাড়া বাংলাদেশের যানজট সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সংস্কার-মুখী মানসিকতা এবং দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ প্রতি বছর অপরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থার জন্য আমরা যে অর্থনৈতিক ক্ষতিতে ভুগছি তা আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে। ট্র্যাফিক সমস্যা শুধু সময় ও অর্থের অপচয় নয়, এটি আমাদের জীবনমানকেও প্রভাবিত করছে। সুতরাং, এখনই সময় আমাদের পরিবহণ নীতি পুনর্বিবেচনা করার এবং আমাদের শহরগুলোকে বাসযোগ্য ও টেকসই করে গড়ে তোলার।

সাব্বির

×