
গ্রাফিক্স: জনকণ্ঠ
একদিন পারস্যের আকাশে যে বসন্ত আসত কবিতা হয়ে, সে আকাশ আজ ধোঁয়ায় ঢাকা। আজ আর শিরাজের পথে প্রেমিকের ছায়া পড়ে না, গোলাপের ঘ্রাণ মিশে গেছে বারুদের গন্ধে। অথচ এই শহরেই জন্মেছিলেন হাফিজ— পারস্যের প্রেম ও ভাবনার কবি। মদের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে তিনি লিখতেন সেইসব কবিতা, যেখানে প্রেম মানে ছিল আত্মার জয়, মানবতা ছিল সবচেয়ে বড় ধর্ম।
হাফিজ তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায় বলেছিলেন— ‘আগার আঁ তুর্কে শীরাজী বদস্ত আ রাদ দিলে মারা/ বখালে হিন্দওয়াশ বখশাম সমরকন্দ ও বোখারা রা।’ বাংলায় এর ভাবার্থ দাঁড়ায়, ‘শীরাজ শহরে যে তুর্কি সুন্দরী আমার হৃদয় ছিনতাই করে চলে গিয়েছে, যদি সে তা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়, তাহলে আমি তার গালের তিলের বিনিময়ে তাকে দুনিয়ার দুই শ্রেষ্ঠ নগরী বোখারা ও সমরকন্দ পর্যন্তও দিতে রাজি আছি।’
ওই একটি পঙক্তিই ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। কারণ ওই কথাটা গিয়ে পৌঁছায় তৎকালীন পৃথিবীর দিগ্বিজয়ী শাসক ও সদ্য পারস্য-জয়ী তৈমুর লঙের কানে। সমরকন্দ ও বুখারা— এই দুই নগর জয় করতে তৈমুর কতই না রক্ত ঝরিয়েছেন! হাজারো মানুষের মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে ছিল তার সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যকে এক কবি বলছেন তুচ্ছ, একটি তিলের চেয়েও নগণ্য! এতে রাগারাগি হওয়াই স্বাভাবিক।
তৈমুর হাফিজকে ডেকে পাঠান। তার রাজসভায় গম্ভীর পরিবেশ। সৈন্যরা ঘিরে আছে, যেকোনো সময় কবির গর্দান উড়ে যেতে পারে। কেউ কেউ ভাবে, হাফিজ এবার বাঁচবেন না। কিন্তু হাফিজ ছিলেন কবি, তিনি ভালোবাসার পক্ষে দাঁড়ান। চুপচাপ দাঁড়িয়ে বলেন, “এই কারণেই তো আমি গরিব হয়েছি। আমি রাজ্য নয়, প্রেমে বিশ্বাস করি। সেই প্রেমের জন্য যদি সব কিছু দিতে হয়, দিই।”
তৈমুর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর হেসে ফেলেন। কবিকে কোনো শাস্তি দেন না। বরং ইতিহাস সাক্ষী হয়ে থাকে— সেদিন রাজা যুদ্ধ জিতেছিলেন, কিন্তু কবি জয় করেছিলেন হৃদয়। এই ঘটনা পারস্যের কাব্যিক গর্ব, যে গর্ব বলে— জোরে নয়, ভালোবাসায় আছে আসল শক্তি।
কিন্তু আজকের পারস্য— অর্থাৎ ইরান তেমন নয়। আজ এখানে শোনে না কেউ ভালোবাসার কথা। এখানে শোনা যায় কেবল ড্রোনের গর্জন, ক্ষেপণাস্ত্রের চিৎকার আর মানুষের আর্তনাদ। শুক্রবার (১৩ জুন) রাতে যখন শহরের মানুষ ঘুমাতে যাচ্ছিল, তখনই ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান ও ড্রোন ঝাঁপিয়ে পড়ে তেহরানের আকাশে। নিশানা করা হয় পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি, এমনকি বাসাবাড়িও। মুহূর্তেই শান্ত রাত পরিণত হয় রক্তাক্ত বিভীষিকায়।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ২২৪ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও হাজারের বেশি মানুষ। যারা বেঁচে আছেন, তাদের ভেতরে কেউ হারিয়েছেন সন্তান, কেউ মা-বাবা, কেউ স্ত্রী কিংবা স্বামী।
এই হামলায় নিহত হয়েছেন ইরানের কয়েকজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, ইসরায়েল এই আক্রমণ চালিয়েছে ইরানের সামরিক ক্ষমতা নষ্ট করার জন্য। তাদের দাবি, তারা ইরানের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করে দিয়েছে, আকাশে তারা নিয়েছে ‘সম্পূর্ণ শ্রেষ্ঠত্ব’।
কিন্তু পারস্য মাথা নত করেনি। ইরানও পাল্টা জবাব দিয়েছে। তারাও ইসরায়েলের দিকে ছুঁড়েছে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র। হাইফা, তেল আবিব, এমনকি জেরুজালেমও আজ সুরক্ষিত নয়। ইসরায়েলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত লেগেছে। মারা গেছেন দুই ডজনের বেশি মানুষ। এ নিয়ে দুই পক্ষই বলছে, যুদ্ধ চলবে, থামবে না।
এদিকে পারমাণবিক দূষণের ভয় বাড়ছে। জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা IAEA জানিয়েছে, ইরানের নাতান্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাইরে তেজস্ক্রিয়তা না ছড়ালেও, ভেতরের বিপদ যে বাড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই ভয়াবহ যুদ্ধের ভেতর, হারিয়ে যাচ্ছে আরেকটি গল্প— কবিতার গল্প, প্রেমের গল্প, শিরাজের সন্ধ্যার গল্প। আজ যদি হাফিজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো বলতেন, “আমার ভাষা পুড়ে যাচ্ছে, আমার শব্দগুলো ছিন্নভিন্ন।” তাঁর সেই শিরাজী রমণী আজ আর স্বপ্ন দেখে না, অপেক্ষা করে হাসপাতালে কারও মৃত্যুর খবরের জন্য, তার চোখে কাজল নেই, তার হাতে নেই মেহেদি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, “এই অভিযান এখনো শেষ হয়নি।” এমনকি খোলাখুলিভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকেও হয়তো হত্যা করতে হবে। এই কথায় স্পষ্ট— এই যুদ্ধ শুধুই সীমান্ত নিয়ে নয়, এটি টিকে থাকার লড়াই, আধিপত্যের লড়াই, আর একটা জাতিকে মাথানত করানোর চেষ্টাও বটে।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে— এই পারস্যে আজ কে জিতবে? হাফিজের মতো প্রেম ও কাব্য? নাকি নেতানিয়াহুর মতো আগ্রাসী যুদ্ধনীতি?
একদিন তৈমুর সাম্রাজ্য নিয়েও হাফিজের হৃদয় জয় করতে পারেননি। কারণ মানুষ যুদ্ধ চায় না, চায় শান্তি, ভালোবাসা, কবিতা। কিন্তু আজকের দিনে কাব্য চাপা পড়ে যাচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দে। আজ কেউ দাঁড়িয়ে বলতে পারছে না— “তেহরান নয়, প্রেম বড়।”
বিশ্বের অনেক দেশ— চীন, তুরস্ক, ইউরোপ শান্তি চাইছে। সবাই বলছে, যুদ্ধ থামাও। কিন্তু যুদ্ধ থেমে নেই। প্রতিদিন বেড়ে চলেছে লাশের সারি, ধ্বংসস্তূপ আর চোখের জল।
তবু আমরা আশা ছাড়ি না। হয়তো আবার জন্ম নেবে কোনো হাফিজ, হয়তো আবার শিরাজ গাইবে প্রেমের গান। হয়তো সেই রমণীর চোখে আবার জ্বলবে সেই আলো, যে আলো একদিন একটি সাম্রাজ্যকে তুচ্ছ করে দিয়েছিল।
তবে তার আগে পার হতে হবে রক্তে ভেজা এই রাত। এই পারস্যে এখন কেউ জেতে না— প্রেমও না, যুদ্ধও না। জেতে কেবল মৃত্যু। আর স্মৃতির পাতায় লেখা থাকে— একদিন ছিল হাফিজ, আর ছিল এক শিরাজী প্রিয়ার গালের অমূল্য এক তিল।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.