
জাহাঙ্গীর আলম সরকার
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিক সমন্বয়ে গঠিত একমাত্র রেজিমেন্ট ছিল ইস্ট বেঙ্গল। যার ছিল মাত্র ৮ ব্যাটালিয়ন সৈনিক। এই ৮ ব্যাটালিয়নের মধ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের লাহোর, করাচিতে ছিল ৩টি ব্যাটালিয়ন। আর পূর্ববাংলায় ৫টি। এ ৫টি ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়কদের মধ্যে দুজন ছিলেন বাঙালি। বাকি তিনজন পাকিস্তানি উর্দুভাষী অবাঙালি। ১৯৭১ সালে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।
এদের মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ছিল যশোরে। যার অধিনায়ক বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল জয়দেবপুরে। অধিনায়ক বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হাসান খান।
মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে সমগ্র দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকগণ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনাতেও সে সম্পর্কে নির্দেশনা ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার মধ্য দিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ২৫ মার্চ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা শহরের বিভিন্ন জনপদে, ছাত্রাবাসে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়।
নিহত হয় অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সৈনিক ও সাধারণ মানুষ। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুরে ২য় ইস্ট বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল, ২৮ মার্চ সৈয়দপুরে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের গণহত্যা ছিল পরিকল্পিত। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী বিভাজন নীতি অবলম্বন করে।
গণহত্যা পরিচালনা করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক লীগের নীলফামারী অঞ্চলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে। ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী’ ও ‘হিন্দু সম্প্রদায়’- এই দুই শ্রেণিকে পাকিস্তানের শত্রু ঘোষণা করা হয়। উল্লেখিত দুটি গ্রুপে চিহ্নিত করে তাদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেনাবাহিনী পরিচালিত গণহত্যাগুলো সফল করতে রাজাকার বাহিনী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালে দেশের অন্যান্য সেনানিবাসের মতো সৈয়দপুর সেনানিবাসেও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা অবস্থান করছিলেন। সৈয়দপুর সেনানিবাসে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২ জন অফিসার ছিলেন। তাদের মধ্যে ৬ জন অবাঙালি ও ৬ জন বাঙালি অফিসার। বাঙালি অফিসারদের মধ্যে লে. আনোয়ার হোসেন, ক্যাপ্টেন আশরাফ হোসেন ও লে. মোখলেসুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দেশমাতৃকার টানে বিদ্রোহ করতে পারে, এমন চিন্তা থেকে পাকিস্তানি সেনা অফিসারগণ গোপন পরিকল্পনা করেন। ৩০ মার্চ (১৯৭১) ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বনাম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এফএফ) এবং ফিল্ড আর্টিলারির একটি শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হয়। সেই চুক্তি অনুসারে সৈয়দপুরে বাঙালি-বিহারি সহাবস্থান করবে। কোনো প্রকার সংঘর্ষে কেউ জড়াবে না।
চুক্তির শর্তানুসারে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্রের গোডাউনের চাবি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স সেনা অফিসারগণ নিয়ে নেন। শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকগণ পরিবারের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েন। কিছু সৈনিক হালকা কিছু অস্ত্র নিয়ে পহারারত অবস্থায় ছিলেন। অন্যদিকে ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফি গভীর রাতে একটি গণহত্যা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা শুরু করে। এই গণহত্যার টার্গেট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফি সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ৭ জন অফিসার নিয়ে একটি গোপন মিটিং করে। ৩১ মার্চ সৈয়দপুর সেনানিবাসে থার্ড বেঙ্গলেও আক্রমণ করে পাকিস্তানিরা। এরপর যথারীতি বিদ্রোহ করে থার্ড বেঙ্গল এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ছড়িয়ে থাকা সব দল-উপদল দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এপ্রিলজুড়ে পার্বতীপুর, বদরগঞ্জ, খোলাহাটি, ফুলবাড়ীয়া ও হিলিতে যুদ্ধ করে থার্ড বেঙ্গল ভারতের কামারপাড়া হয়ে তেলে ঢালায় মেজর শাফাত জামিলের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয়।
১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফির অধীনে ২৩ ফিল্ড আর্টিলারি এবং কর্নেল হাকিম এ কোরেশীর অধীনে ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এফএফ) তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ওপর গণহত্যা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আক্রমণ করে। হতচকিত হয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকগণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এই যুদ্ধের একপর্যায়ে ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের (এফএফ) ক্যাপ্টেন ফিদা নিহত হন।
যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ১৫০০ বাঙালি অফিসার ও সৈনিকগণের মধ্যে প্রায় সকলেই নিহত হন। কোয়ার্টারে অবস্থানরত স্ত্রী-কন্যাদের পাশবিক নির্যাতন ও গণহত্যা চালানো হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকাংশ লাশ সেপটিকট্যাংকে ফেলে দেওয়া হয়। প্রায় ৩০০ জন সৈনিকের লাশ সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের মাঠে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছিল।
ওইদিন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গণহত্যার পর সৈয়দপুরে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে গণহত্যা শুরু হয়। সেই সূত্র ধরে হাউজিং এবং সেটেলমেন্ট বিভাগের মহকুমা ইঞ্জিনিয়ার ফজলুর রহমানের বাঙালিপুরের বাসভবনে ২০ জন পাকিস্তানি সেনা আক্রমণ করে। তারা পরিবারের সবাইকে হত্যা করে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানে ইস্ট বেঙ্গলের যে ৩টি রেজিমেন্ট ছিল, সেখান থেকে অনেক অফিসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাকিরা ১৯৭৪ সালে স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও পুরো যুদ্ধকালে সর্বত্রই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কেউ কেউ পাকিস্তান বাহিনীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। বাঙালি সেনাদের অনেকে পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হন সে সময়ই।
মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভূমিকা অতুলনীয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকরা কীভাবে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতন-গণহত্যা মোকাবিলা করে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সমগ্র যুদ্ধে তাদের কৌশল ও আত্মত্যাগের বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। একটি প্রবন্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের সব তুলে আনা সম্ভব নয়।
লেখক : আইনজীবী ও পিএইচ.ডি গবেষক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়