
ছবি: সংগৃহীত
সত্তরের দশক,উত্তাল বাংলা! সামাজিক ও রাজনীতির উত্থান-পতন, ত্যাগ-প্রাপ্তি এবং পরিশেষে বিশ্বের বুকের শকুনের ছোবল থেকে সবুজের জমিনে লাল উদীয়মান সূর্যের উদয়।ইতিহাসে প্রবল এই সংকটময়তার ছায়া মাড়িয়েছে প্রতিটি বাঙালির জীবন; সাধারণ শান্তিকামী বাঙালি হতে শুরু করে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী কেউই বাদ যাননি।বাঙালি জাতির সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নবরূপে শানিত হয়েছে যে মহালগ্নে, যাদের কলমের ধারে গুড়িয়ে গেছে শত্রুর বেয়নেট; ঠিক সেই সময়েই একজন নব কাণ্ডারীর উত্থান হয়েছিলো। যিনি কীনা “জাতির পতাকা খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন” বলে দেশবাসীকে সেই শাশ্বত মূহুর্তের কথা স্মরণ করাতে থাকেন যখন আমাদের জাতীয় পতাকা তাঁর পরিচয় লাভ করেছিলো; সেই রক্তাক্ত জাতীয় পতাকা যার মধ্য কীনা কবি তাঁর ধর্ষিতা বোনের শাড়ি খুঁজে পেতেন। ৩৪ বছর পূর্বে কেবল ৩৪ বছর বয়সে অকালপ্রয়াণ হওয়া কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর মৃত্যবার্ষিকী আজ।
প্রারম্ভিক জীবন:
শেখ ওয়ালীউল্লাহ, খানজাহান আলীর মুরিদ ধোনাই খা এর প্রপৌত্র হওয়ার সুবাদে অঢেল সম্পত্তি এবং ব্যাপক নামডাকের অধিকারী ছিলেন। তাছাড়া পেশায় তিনি একজন চিকিৎসকও ছিলেন, নিজের ব্যাপক প্রসার এর প্রতি সুবিচার করে তিনি বিবাহ করেন তদানীন্তন মংলার অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তি শেখ মহম্মদ ইসমাইলের একমাত্র মেয়েকে। তাদের ঘরে জন্ম নেওয়া ১০ সন্তানের সর্বঅগ্রজ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ; যাকে পরবর্তীতে দেশবাসী জেনেছিলো রোমান্টিক ও দ্রোহের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পরিচয়ে। ডাক্তার বাবার স্বপ্ন ছিলো ছেলেকে নিজের মতো ডাক্তার বানাবেন; রুদ্রও সেই পথ ধরেই আগাচ্ছিলেন। তবে পাশাপাশি নানাবাড়িতে আসা ‘বেগম’ ও ‘শিশুভারতী’-এর কল্যাণে পদচারণা হতো সাহিত্যের অপারক্ষেত্রে; আটবছর বয়সেই রপ্ত করে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ,নজরুলের মতো দিগ্বজদের।এভাবেই চলতে থাকা রুদ্র সাক্ষী হয় বাঙালির সেই শাশ্বত কালজয়ী অধ্যায়ের; ক্লাস নাইনে পড়ুয়া রুদ্র তখন চোখের সামনে দেশমাতৃকার সূর্যসন্তানদের দেশ ও জাতির জন্যে অকাতরে জীবন বিলাতে দেখেন। বাবার দেখানো পথের পাথেয় হওয়া রুদ্রের তখন নিজের জীবনের লক্ষ্য ঘাসের উপরে জমে থাকা শিশিরবিন্দুর ন্যায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দশম শ্রেণিতে ঢাকায় এসে উঠেন মামার ৫০, লালবাগের বাসায়; ধারণ করেন নিজের সেই রুদ্র অবতার। ৪টি লেটার মার্ক্স নিয়ে বিজ্ঞান শাখায় মেট্রিক ও ২ বছরে কেবল ১৮ দিন ক্লাস করে ঢাকা কলেজ থেকে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেন। এরপরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, সাথে পেয়ে যান ইসহাক খান,আলী রিয়াজের মতো একঝাক নবীন সাহিত্যঅনুরাগীদের। ১৯৭৮ সালে রুদ্র ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে সাহিত্য সম্পাদক পদে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কামাল চৌধুরী (ছাত্রলীগ) ও আলী রিয়াজ (জাসদ ছাত্রলীগ)। সেবার সাহিত্য সম্পাদক হন আলী রিয়াজ। রুদ্র সরাসরি কখনো রাজনীতিতে না এলেও ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রকাশ করেন তার রাজনৈতিক বিশ্বাস। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার চেয়ে সাহিত্যচর্চায় অধিক মনোনিবেশ করায় ক্রমশই শ্লথ হয়ে আসে পড়াশোনায়; তবুও ১৯৮০ তে তিনি অনার্স এবং ১৯৮৩ তে নেন এমএ ডিগ্রি।
স্বর্ণজীবন:
কবি ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন ব্যাপক সাহিত্যপিপাসু, নিজের তাড়না থেকেই ভাইবোনদের সাথে মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘বনফুল’ নামক পাঠাগার। এরপর ১৯৭৩ সালে দৈনিক ‘আজাদ’
পত্রিকায় বেনামে নিজের জীবনের প্রথম কবিতাটি লিখেন। “আমি ঈশ্বর আমি শয়তান” কবিতাটিতে কবির পূর্ণাঙ্গ প্রতিভার ঝলক না পাওয়া গেলেও আবেগ ও উদ্দীপনায় পূর্ণ জীবনদর্শন এবং চিন্তাধারার সুস্পষ্ট দিগন্ত রচনা করেছিলো।এরপর বিভিন্ন সময়ে সময়ে পত্রিকায় লেখালেখি ও সম্পাদনা চালিয়ে যান।
১৯৭৯ সালে কবির প্রথম কবিতার বই “উপদ্রুত উপকূল” প্রকাশিত হয় যার প্রকাশক ছিলেন আহমদ ছফা। এই গ্রন্থেই প্রকাশিত হয়েছিলো সাড়া জাগানিয়া “বাতাসে লাশের গন্ধ” কবিতাটি। এই কবিতার কয়েকটি পংক্তি–’জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’ কিংবা ‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা’ প্রবল আলোড়ন তুলেছিলো পাঠকসমাজে; কবি জানান দিয়েছিলো তাঁর অবাধ প্রতিভার। প্রথম গ্রন্থেই কবি নিজেকে আখ্যায়িত করেছিলেন “শব্দশ্রমিক” হিসেবে। বলেছিলেন “আমি কবি নই–শব্দশ্রমিক/শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়”। এই বইয়ের জন্য পরবর্তীতে তিনি মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮১ সালে দ্রাবিড় থেকে প্রকাশিত হয় কবির দ্বিতীয় বই “ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম”। বাঙালি জাতির প্রেরনাময় ঐতিহ্য,আত্মানুসন্ধান ও স্বরূপ ভাষায় অন্বেষণের অন্ততাগিদ কবির স্বর্ণগ্রামের মাধ্যমে পাঠকের মনে ধরা দিয়েছে। কবির অসামান্য নৈপুণ্য ও লেখনশৈলির কল্যাণে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
বছর তিনেক পর ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় “মানুষের মানচিত্র”। বিপ্লবী লেখক হিসেবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সম্মুখভাগে থেকে লেখনী কিংবা নেতৃত্বের মাধ্যমে ক্রমাগত প্রেরণা জুগিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে চতুর্থ কাব্য ‘ছোবল’ প্রকাশিত হয়।এরপর ক্রমে ক্রমে পঞ্চম কাব্য ‘গল্প’(১৯৮৭) ও ষষ্ঠ কাব্য ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’(১৯৮৮) প্রকাশিত হয়। এ কাব্যে কবির কলমের ধার অনেকগুণ বেশি সংহত ও উদ্যম ছিলো। এ কাব্যে কবির রুদ্র-অবতারের পাশাপাশি বিপ্লবের বারুদ ও ধোঁয়ায় আড়াল হওয়া ভালোবাসার আভাস পাওয়া গিয়েছিল।
কবি বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে বরাবরই চিন্তাক্লিষ্ট ছিলো, কিন্তু তিনি একই সাথে প্রবল প্রেরণাদায়ক মন্ত্রের জয়গান গেয়ে চলেছিলেন। দেশের মানুষকে স্রেফ কাব্য নয় বরং নাট্য,চলচ্চিত্র ও সংগীত রচনার মাধ্যমে তিনি সমৃদ্ধ করার প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন।
The Swan Song:
দেশ ও জাতিকে নিয়ে ভাবনা করা কবি বরাবরই নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিলেন উদাসীন। তুখোড় ধূমপায়ী হওয়ায় ও খাবার নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম করে পাকস্থলীতে আলসার বাধিয়েছিলেন। অযত্নে পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জাস ডিজিজ। ডাক্তার বলেছিলেন, পা’টাকে বাচাঁতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। পা এবং সিগারেটের যে-কোনো একটাকে বেছে নিতে বলেছিলেন। কবি সিগারেট বেছে নিয়েছিল। নিজের শেষ সময়টায় নীলক্ষেত-বাবুপুরায় কবি অসীম সাহার “ইত্যাদি”-তে নিয়মিত ছিলেন; টেবিলের বাঁ পাশে বসে বেলার পর বেলা নিমগ্ন বসে কাটিয়ে দিতেন। তবে একদিন আর তাঁকে সেই টেবিলের বাঁ পাশে দেখা গেলো না, পেপটিক আলসারে জর্জরিত পাকস্থলী নিয়ে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। কবিকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন সাবেক স্ত্রী ও লেখিকা তসলিমা নাসরীন। কবির চুলে ও কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- “ভেবো না, তুমি শিগরি সেরে উঠবে”; শুনে কবি মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন- “ কী জানি, এই যাত্রাই শেষ যাত্রা কিনা”। সে যাত্রাই বেঁচে গিয়েছিলেন কবি; তবে আসলেই কী তাই? ২০ জুন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন। পরের দিন ২১ জুন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃক্রিয়া করে দাঁত ব্রাশ করতে বেসিনে দাঁড়িয়েছিলেন। হ্ঠাৎ তিনি মুখ থুবড়ে বেসিনের উপর পড়ে যান; বেসিন কবির ভর বইতে না পেরে ভেঙে গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। ভোর সাড়ে সাতটায় কবি প্রকৃতির অমোঘ নিষ্ঠুর ছোবলের কাছে মাথা পেতে নেন। অনুজ সহোদর ডাক্তার সাইফুল্লাহ জানান, কবির মৃত্যু হয়েছিলো Sudden Cardiac Arrest-এ।
কবির মৃত্যুর খবরে সারাদেশে দোলাচল বয়ে যায়। ৩৪ বছর বয়সী তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল এই কবির মৃত্যুর খবরে রাজধানী ঢাকার লেখক, শিল্পী মহল ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। কবির অকালপ্রয়াণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শামসুর রাহমান বলেন, বুদ্ধদেব বসু তার একটি লেখায় বলেছেন, মাঝে মাঝে সাহিত্য ভোগ নিয়ে থাকে। তার এই উক্তির উপলক্ষ ছিলো অকালপ্রয়াত, উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতিশীল, অধুনা বিস্মৃত কবি সুকুমার সরকার। বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্য প্রায় পনেরো বছর আগে ভোগ নিয়েছিল প্রতিভাবান তরুণ কবি আবুল হাসানকে। তার নামের সঙ্গে এ-বছর যুক্ত আরেকটি নাম, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। আহমদ ছফা শুধু বললেন, আহ আফশোস!
পরিশেষে সত্তরের রাগী, দ্রোহী, সময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। সুন্দরবনের সুন্দর গাছগুলোকে অব্যক্ত বেদনায় নীল করে কবি অন্তিমশয়ানে চলে যান তার চিরচেনা, শৈশবের স্মৃতিধন্য মংলার মিঠেখালিতে। তাই তো আজও কবিহীনা চতুর্ত্রিংশ বার্ষিকীতেও বাঙালির মনে অবিরাম বয়ে যায়-
“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে
যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।”
আঁখি