ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

আমরা নারী-আমরাই পারি

তামান্না হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৫২, ৭ মার্চ ২০২৪; আপডেট: ১১:১০, ৮ মার্চ ২০২৪

আমরা নারী-আমরাই পারি

নারীবাদ মানেই পুরুষ বাদ দিয়ে নয়

নারীবাদ মানেই পুরুষ বাদ দিয়ে নয়। পুরুষ-নারী একসঙ্গেই পথ চলবে। নারী-পুরুষের সমতাই কাম্য। নারী দিবস মানে নারীর অধিকার আদায়ের দিবস। নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন, সুশাসন, শিক্ষা, উপার্জন, নিরাপত্তা- যতগুলো সূচক আছে নারীর সফলায়নে সেই সূচকগুলো কি স্পর্শ করেছে? সেই সূচক যেন আর পিছিয়ে না থাকে। নারীবান্ধব আইন করা এবং সেটা শক্তভাবে যেন প্রয়োগ হয়। নারীকে সমান মর্যাদায় দেখা, নারীর আয়কে পুরুষের সহযোগী আয় হিসেবে গ্রহণ করাতে সচেষ্ট হতে হবে শক্তভাবে

দিন বড় হচ্ছে। কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় অন্ধকারের যে চাদরটা ছড়িয়ে থাকত তা আর নেই। ভোরেও কাটছে কুয়াশা। দেখা যায় আলোর রেখা। দিনের আলোরও সাশ্রয় হবে এই সপ্তাহেই। আবার এই  সপ্তাহেই  বিশ্ব নারী দিবস। দিবসের তো শেষ নেই। এরই মাঝে বিশেষ কিছু দিবস ভালোলাগায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিছুই করা হয় না। তবুও আছে এই রকম একটা দিবস, সেটাই ভালোলাগা। ভালোবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস... জায়গা করে নিয়েছে বহু আগে থেকেই।

আজকাল যুক্ত হয়েছে আরও অসংখ্য দিবস। এর মাঝে ভাই-বোন দিবস, বোন দিবসটা মনেতে আবির ছড়ায়। ভাই-বোন প্রিয় সেটা প্রিয়তর হয় সেই দিনটাতে। বোনের জন্য যে অনুভূতি ভালোবাসা তার জন্য তো আর দিবস লাগে না...  তবুও। ভালোবাসার আবেশ।
নারী দিবসের জন্ম তো সেই কবেই। যার পূর্ব নাম ছিল আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদ্যাপন করে থাকেন। বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারী দিবসের প্রধান লক্ষ্য এক এক রকম হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধাই উদ্যাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও মহিলাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানটি বেশি গুরুত্ব পায়। 

এই দিবসটি  উদ্যাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলেও চলে সরকারের  লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। 
জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়।

ক্লারা ছিলেন রাজনীতিবিদ, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। সময়টা  ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনেই ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে।

দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। জাতিসংঘ দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায়। এর পর থেকে পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভিলাষ নিয়ে।
কিন্তু বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা আজও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। পাশবিক সহিংসতা তো আছেই। ঘরে-বাইরে কোথাও নারী নিরাপদ নয় আজও। এটার জন্য দেশের বিদ্যমান আইনও দায়ী। নারী সমাজের পক্ষ থেকে এই বৈষম্যর জন্য যে আন্দোলন তা স্বীকৃতি ও বাস্তবায়ন উপেক্ষিত রয়েই গেছে। নারী-পুরুষের হার সমানুপাতিক।

শতকরা ৬৫ ভাগ নারী আয় করে, কিন্তু পুরুষের তুলনায় পারিশ্রমিক পায়  ১৬% কম। ১০০ ভাগের মধ্যে মাত্র ১ ভাগ নারী সম্পতির মালিক। উন্নয়নশীল দেশে ৬০ কোটি নারী আজও দারিদ্র্যসীমার নিচে। উন্নত দেশেও  ২০ থেকে  ২৫ শতাংশ নারী দরিদ্র। বিশ্বের অশিক্ষিত জনসংখ্যার  দুই-তৃতীয়াংশই নারী। আর ৭০% নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

আমাদের দেশে সামগ্রিক আয়ের ৭৬% আসে পোশাক খাত থেকে, যেখানে সিংহভাগই নারী কর্মী। আর সেই নারীরাই নিগৃহীত নির্মমভাবে বাড়িতে, গাড়িতে, কর্মস্থলে। যে শঙ্কা থেকে এক শতাব্দীরও আগে রচিত হয়েছিল দিবস তা আজও পূর্ণতা পায়নি।

১৯৪৯ সালে ফরাসি লেখিকা বুদ্ধিজীবী দার্শনিক সিমোন ডি বিভোয়ার (ঝরসড়হব উব ইবধাঁড়রৎ) লেখেন  ঞযব ঝবপড়হফ ঝবী. সেখানে তিনি প্রশ্ন তোলেন নারী কে, নারী কি। নারীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি দুটি  আখ্যা (টার্ম) প্রদান করেন- একটি  সেক্স আর একটি হলো জেন্ডার। তিনি জানান, সেক্স হলো দেহগত বৈশিষ্ট্য  আর জেন্ডার এক সামাজিক নির্মাণ।

এই নির্মাণে প্রধান ভূমিকা পুরুষের। পুরুষ তার নিজের প্রয়োজনে, আধিপত্য কায়েম রাখতে প্রায় সর্বস্তরে অবদমিত করে  ধীরে ধীরে নারীকে নির্মাণ করেন। তিনি আরও বলেন, নারী জন্মায় না, নারীকে তৈরি করে। আর এই নির্মাণের প্রধান কারিগর পুরুষ। 

অন্দর মহল থেকে বেরিয়ে  আসা   কুসংস্কারমুক্ত, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সচেতন, শিক্ষিত, স্বনির্ভর এই নারীই পারে নারী-পুরুষের সমতা বিধানের, সমমর্যাদার ভিত্তিতে মানবসভ্যতার নতুন ইতিহাস রচনা করতে। পুরুষের মতোই নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার অর্জনের মাধ্যমে নতুন বিশ্বে দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম এই নারী।

নারীর অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে পুরুষ যদি সঠিক চিত্রটি দেখতে না পায়, নারী-পুরুষের মধ্য সামাজিক ক্ষমতার অসম বিন্যাসের সূত্রটি যদি পুরুষ খুঁজে না পায়, নারীর অবদমন, নির্যাতনের পাশে নিজেকে যদি সমান অনুভূতিসম্পন্ন হিসেবে পুরুষ উপলব্ধি করতে না পারে...
নারীর আগে নয় নারীর পাশে যদি পুরুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে না পারে  তা হবে মানুষ হিসেবে পুরুষেরও লজ্জা, তা হবে দুঃখজনক। আমি এক শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি জানো ওমেন্স ডে কবে? সে অবাক হলো। আমাকে উল্টো জিজ্ঞেস করে- কি হয় এইদিনে? ম্যামোগ্রাম করে?  যাক, তবুও সচেতন আছে কিছুটা। শান্তি পেলাম। সোমালিয়ান মহিলা বলেন, শুনেছি এই দিনটার কথা। আর জানি না কিছুই। এক কৃষাঙ্গ মহিলার সঙ্গেও আলাপ চালাতে চেষ্টা করলাম।

ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা সবাই জানি  তাদের পূর্ব পুরুষদের শেকল পরিয়ে শিকড় উপড়িয়ে আনার সেই নির্মমতার কথা। তারা যে আজও নিদারুণ বৈষম্যের শিকার কি ভাবে তা? আজও প্রায় সব অফিসেই ফ্রন্ট ডেস্কে শ্বেতাঙ্গ নারীরাই অগ্রগণ্য। যোগ্যতা অধিক, তবুও কৃষাঙ্গ নারী চাকরি পায় না। পেলেও বেতনের তারতম্য। কৃষাঙ্গ নারী এক প্রকার হাল ছেড়ে দিয়েই বলে,  জীবন আমার। সেটাকে চালিয়ে নেওয়াতেই আমার আনন্দ। কোনো দিবসেই আমার আমিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না আমি নিজে যদি সংগ্রাম না করি। নারী দিবস কি আমি জানি না।

আইন প্রণেতারা যদি ন্যায়বিচারক না   হোন, তাদের ভেতর যদি মানবপ্রেম না থাকে তা হলে কোনো দিবসেই সফল হবে না। হতাশ সে। লাতিন আমেরিকার মেয়েরা একদমই নির্বিকার। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। একজন শুধু বলল, সেদিন কি মেয়েরা ভায়োলেট কালার পরবে? আমিও তা হলে সেই কালারের ড্রেস পরব। আমি ভাবি হেসে-খেলে জীবনটা চলে যাক।
২০২৪ সালের  ১১৩তম এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে  ইন্সপায়ার অ্যান্ড ইনক্লুশন। অনুপ্রেরণা আর অন্তর্ভুক্তি। উৎসাহর সঙ্গে অন্যকে অন্তর্ভুক্ত করা। যারা পিছিয়ে আছে তাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তিন রং নিয়ে নারী দিবস। বেগুনি ন্যায়ের, সবুজ আশার আর সাদা বিশুদ্ধতার।  
নারীবাদ মানেই পুরুষ বাদ নয়। পুরুষ-নারী একসঙ্গেই পথ চলবে। নারী-পুরুষের সমতাই কাম্য। নারী দিবস মানে নারীর অধিকার আদায়ের দিবস। নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন, সুশাসন, শিক্ষা, উপার্জন, নিরাপত্তাÑ যতগুলো সূচক আছে নারীর সফলায়নে সেই সূচকগুলো কি স্পর্শ করেছে? সেই সূচক যেন আর পিছিয়ে না থাকে।

নারীবান্ধব আইন করা এবং সেটা শক্তভাবে যেন প্রয়োগ হয়। নারীকে সমান মর্যাদায় দেখা, নারীর আয়কে পুরুষের সহযোগী আয় হিসেবে গ্রহণ করাতে সচেষ্ট হতে হবে শক্তভাবে। নারীর বিচরণ যেন হয় সহজ। এই পথ মসৃণ ছিল না তখনো, এখনো। বর্তমানকে গ্রহণ করাই আধুনিকতা। নারী দিবস মানে অনাধুনিক কাজ না করা। নারী দিবসের মতো পুরুষ দিবসও আছে। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯ নভেম্বর এই পুরুষ দিবস পালন করা হয়। পুরুষের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।

বিশ্বের ৬০টি দেশে এই পুরুষ দিবস পালন করা হয়। যদিও এই দিবসটি এখনো জাতিসংঘের অনুমোদন পায়নি। তবে আমরা নারী, আমরাই পারি। বিশ্বের সকল নারীকে শেকল ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় তৈরিতে আরও ঐক্যবদ্ধ শক্তি প্রয়োগ হোক- এই প্রত্যাশা সর্বদাই।
লেখক : আটলান্টা প্রবাসী

×