
.
২০০০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পেছনে রয়েছে কানাডা প্রবাসী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামের উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী ২৮টি দেশের সমর্থনে ইউনেস্কো এ ঘোষণা দেয়। সারা বিশ্ব জানতে পারে ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালিরা জীবন উৎসর্গ করেছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই ঘটনায় বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। বিশ্বের সকল দেশকে বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যময় আলোকিত দিন। এই দিনে পৃথিবীর সব দেশের সকল ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর মানুষই স্মরণ করে থাকে তার নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য। কেননা, বিশ্বের প্রতিটি ভাষাই বিশ্ব সভ্যতার অমূল্য সম্পদ।
মাতৃভাষার অধিকার এখন প্রায় মানবাধিকারের সমপর্যায়ের। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর কোনো সভ্যদেশ কারও মাতৃভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারবে না। বাংলাদেশে বাংলাভাষী ছাড়াও আরও প্রায় ৪৫টি জাতিগোষ্ঠীর বাস রয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরই কমবেশি স্বতন্ত্র মাতৃভাষা রয়েছে। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার প্রায় ৬০ শতাংশ। সম্প্রতি কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কিন্তু এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিস্তৃত এবং প্রসারিত করতে হলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, বলিভিয়া, নাইজিরিয়া আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারও দিনবদলের লক্ষ্যে মানসিকতা পরিবর্তনের পাশাপাশি উচ্চ প্রযুক্তির ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে। শিক্ষা ছাড়া প্রযুক্তি যেমন অচল, তেমনি একটি জাতির মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। সেই শিক্ষা দিতে হবে মাতৃভাষায়। ভাষার প্রধান কাজ শিক্ষাক্ষেত্রে। বর্তমান সরকার ১৯৭৩ সালের ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টকে যুগোপযোগী করে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করে চলেছে। ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ‘সবার জন্য শিক্ষা’- নিশ্চিত করার নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই কর্মসূচি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় তবে একুশ যে চেতনা, যে দাবি, যে প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিল তার খানিকটা পূরণ হবে।
প্রতিটি ভাষা দিবসে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে অথবা বিভিন্ন আলোচনা সভা, সেমিনার, বইমেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমরা অন্যান্য অঙ্গীকারের সঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর অঙ্গীকার করে থাকি। এই অঙ্গীকার ব্যক্তিগত নয়- জাতীয়। এই অঙ্গীকার পালনে আমরা জাতি হিসেবে দায়বদ্ধ। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজও সেই অঙ্গীকার পূরণ হয়নি। যদিও ব্যক্তি জীবন, রাষ্ট্রীয় পর্যায় এবং বিশ্বে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি কাজের অনেকটাই বাংলা ভাষায় করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নিম্ন সহকারী পর্যন্ত সকলেই তাঁদের প্রশাসনিক কাজ বাংলা ভাষায়ই সম্পন্ন করেন। আদালত, সরকারি ব্যাংক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড সকলেই তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টিভি চ্যানেল ইত্যাদি প্রচার মাধ্যম এবং শিল্প, সাহিত্য, সংগীত নাটক সবই বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রচার এবং প্রসার ঘটছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও। একুশের বইমেলা তার উজ্জ্বল নিদর্শন।
তবে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে বাংলাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, বরং অনীহা প্রকাশ করে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, মাতৃভাষা বলে বাংলাকে যেন আমরা যেমন তেমন করে ব্যবহার না করি। অন্যান্য ভাষা শিক্ষার মতো বাংলা ভাষাকেও আমাদের সুন্দরভাবে শিখতে হবে। যাতে আমরা বাংলা ভাষাকে জীবনের সর্বস্তরে শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে ব্যবহার ও প্রয়োগ করতে পারি। আজকাল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নানা অনুষ্ঠানে, নাটকে, কথোপকথনে বা বক্তব্য প্রদানে যেভাবে বাংলার ব্যবহার হয়, তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও দৃষ্টিকটু। একই বাক্যের মধ্যে দেখা যায় বাংলা, ইংরেজি, হিন্দির মিশ্রণ ঘটেছে। উচ্চারণ বিভ্রাট, আঞ্চলিকতা এ সব তো রয়েছেই। ভুললে চলবে না, শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ বাংলা ভাষার মর্যাদাকে যেমন রক্ষা করবে, তেমনি এর উৎকর্ষও বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি দিকনির্দেশনার পাশাপাশি চাই জনগণের সচেতনতা, আন্তরিকতা, ইতিবাচক চিন্তা-চেতনা এবং মন-মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা আশাবাদী। আমরা বিশ্বাস করি একদিন না একদিন আমাদের সে প্রত্যাশা পূরণ হবে। কেননা, একুশ আমাদের হারতে শেখায়নি। একুশ আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছে।
জনসংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশের ১৬ কোটি, ভারতবর্ষে ১৫ কোটি, এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে আরও ৫ কোটি, সব মিলে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। সে হিসেবে বাংলা বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। লিপির দিক থেকেও বাংলা ভাষার অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। কারণ, বাংলা ভাষা ছাড়াও অহমিয়া, মণিপুরী, নাগা, চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা ইত্যাদি ভাষা বাংলা লিপি ব্যবহার করে। বিশ্বায়নের যুগে কম্পিউটারের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাভাষাকে শিল্প, সাহিত্য এবং ব্যবসা বাণিজ্যর ক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে। একসময় কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা ছিল। বর্তমানে বিপুল সংখ্যক ওয়েবসাইট বাংলায় তৈরি হচ্ছে। ইউনিকোড মানকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাংলায় ইন্টারনেট প্রকাশনা যেমন নতুন মাত্রা পাচ্ছে, তেমনি এর ব্যবহারও ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিবিসির মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান এখন ওয়েবসাইট প্রকাশ করছে। ই-মেইলে, ফেসবুকে ইন্সট্যান্ট মেসেজিং বা চ্যাটে চমৎকারভাবে বাংলার ব্যবহার হচ্ছে এবং দ্রুত এর প্রসার ঘটছে। দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত বলে ধারণা করা হয়। তাদের সিংহভাগই মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজ করে। যেহেতু মোবাইল ফোনে বাংলার প্রচলন এখনো তেমনভাবে হয়নি, সেহেতু ইন্টারনেটে বাংলার ব্যবহার সীমিত। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মোবাইল ফোনে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার ফলে বাংলার ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে।
একুশ আসে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে। এই সম্ভাবনার আরও দুয়ার খুলে দেবে যদি বাংলাদেশ ইউএনএলের (ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ) সদস্যভুক্ত হয়। বর্তমানে ইউএনএলভুক্ত ভাষার সদস্য সংখ্যা ১৬৫। কিন্তু বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ ভাষা বাংলা এখনো এর সদস্যপদ নিতে পারেনি। এই সদস্যপদ নেওয়ার জন্য কিছু পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন। যেমনÑ ইউএনএল নির্মিত ছকে বাংলা ভাষার একটি ডিজিটাল অভিধান ও একটি ডিজিটাল শব্দকোষ তৈরি করা। ইউএনএলের পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ ফাউন্ডেশন, জেনেভা। বিশ্বের প্রতিটি ভাষা যেন ইউএনএলের সুবিধা নিতে পারে এবং প্রত্যেক মানুষ যেন অবাধে এর ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য ইউএনএল বিনামূল্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ বাংলাকে এই প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অবকাঠামো ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে।
প্রযুক্তিবিদ ও ভাষাবিদদের সমন্বয়ে একদল গবেষক ও কলাকুশলি ইউএনএল প্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করতে পারে এমন একটি ডিজিটাল শব্দকোষ ও অভিধান নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন। গবেষকরা মনে করেন, রবীন্দ্রসাহিত্য অভিধান তৈরি ও ভাষা নির্মাণে একটা বড় ভূমিকা রাখবে। এশিয়াটিক সোসাইটির এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কলকাতার এসএনএলটিআর। আশা করা যায়, দেশী-বিদেশী গবেষকদের চেষ্টায় স্বল্প সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। বাংলাভাষাও ইউএনএলের সদস্যভুক্ত হয়ে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমোদন পাবে। তাতে বাংলা ভাষার ব্যবহার হয়ে যাবে বহুমাত্রিক। বিশ্বের যে কোনো দেশের যে কোনো প্রান্তের যে কোনো বাংলাভাষাী মানুষ একটি মাত্র বোতাম টিপে অন্য ভাষাকে যেমন নিজের ভাষায় পড়তে পারবে, ঠিক তেমনি অন্য ভাষার মানুষও বাংলা ভাষার রসাস্বাদন করতে পারবে নিজের ভাষায়। এর জন্য বিদেশী ভাষা শেখার দরকার হবে না। ডিজিটাল বাংলা বিশ্বকে নিয়ে আসবে হাতের মুঠোয়। খুলে দেবে সম্ভাবনার নব দুয়ার। বাংলা ভাষা যদি তার স্বকীয়তা, বৈশিষ্ট্য, মাধুর্য ও উৎকর্ষ বজায় রেখে ইউএনএলের সদস্যভুক্ত হয়ে শিল্পে, সাহিত্যে, ব্যবসায় বাণিজ্যে স্থান করে নিতে পারে, তবে তা হবে বাংলা ভাষার নবদিগন্তের নবযাত্রা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, চেয়ারম্যান, ট্রাস্টিবোর্র্ড, নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যশনাল
ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী