
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ধেয়ে আসা মন্দা মোকাবিলায়
কৃষির ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, তার ফলে এই খাত আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই অর্জনগুলোকে টেকসই করা সম্ভব হয়েছে ম্যাক্রো-অর্থনীতির পাশাপাশি বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের দিকে সমানতালে নীতি-মনোযোগ দেওয়ায়। উন্নয়ন অভিযাত্রার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো এর অংশগ্রহণমূলক ধরন
বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ধেয়ে আসা মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশের বিচক্ষণ নেতৃত্ব সময়োচিত সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সৎসাহস দেখিয়েছে। সেসব সিদ্ধান্তের মূলে ছিল আমাদের স্বদেশী উন্নয়ন নীতি-কৌশলের শক্তি ও গতিশীলতা। একই সঙ্গে আমরা বাইরের উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতা নিতেও কার্পণ্য করিনি। ঘরে-বাইরের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলমান সংকট মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সতর্কতামূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে সম্মত হয়েছে।
সম্প্রতি আইএমএফের বোর্ডে বাংলাদেশের জন্য ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ অনুমোদিত হয়েছে। অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতির ফলে পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের একেবারে বাইরে চলে যায়, তখনই সরকারগুলো আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। আমাদের নীতি-নির্ধারকরা বিদ্যমান বাস্তবতার বিষয়ে সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়ে আগেভাগেই আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন বলেই আইএমএফ যথাসময়ে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তকে খুবই সময়োচিত বলে প্রশংসা করেছেন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। বাংলাদেশের পরম সুহৃদ এই অর্থনীতিবিদ সংকট মোকাবিলার জন্য আগাম চিন্তার যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন।
আইএমএফের তরফ থেকে এ সিদ্ধান্তে এ যাবৎকালে (বিশেষত গত ১৪-১৫ বছর সময়কালে) বাংলাদেশের ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বাস্তবমুখিতা এবং আগামীর সম্ভাবনার বিষয়ে বৈশ্বিক নীতি-নির্ধারকদের আস্থাটুকু প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের দেখানোর পথে অন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও এগিয়ে আসবে বলে ধারণা করা যায়। বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে সরকারকে দেওয়া বাজেট সহযোগিতার পরিমাণ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এডিবি আগে থেকেই বাংলাদেশে বেশি করে বিনিয়োগ করে যাচ্ছিল। এখন আরও করবে। জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকাও একই পথে হাঁটছে। এরই মধ্যে পাতালরেলের জন্য ৪.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের এমন ইতিবাচক মনোভাব দেশের সংকটকালে বিশেষ ভরসা দিচ্ছে- তা ঠিক।
তাদের এমন এগিয়ে আসাটি প্রত্যাশিতই ছিল। কেননা, গত ১৪-১৫ বছর ধরে খুবই মুনসিয়ানার সঙ্গে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালিত হয়েছে। এতে করে একদিকে ২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মুখেও আমাদের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক থেকেছে। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি বাড়ার ফলে বাড়তে থাকা মাথাপিছু আয়ের সুফল সামাজিক পিরামিডের পাটাতনের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রও নিশ্চিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারীদের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও এ সময়টিতে অন্য অধিকাংশ ইমার্জিং ইকোনমির চেয়ে আমরা সাফল্য দেখিয়েছি। সর্বোপরি, আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রধানত নিজস্ব চাহিদার ওপর ভর করে (জিডিপির ৭৩ শতাংশ ভোগ থেকে আসছে)। তাই অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে টেকসই।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ৬১ শতাংশই হয়েছে এ সময়ে (বর্তমানে বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি)। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধির ৬০ শতাংশ এ সময়ে হয়েছে। আর রিজার্ভের আকার যতটা বেড়েছে তার তো ৮৭ শতাংশই এ সময়ে। কৃষির ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, তার ফলে এই খাত আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই অর্জনগুলোকে টেকসই করা সম্ভব হয়েছে ম্যাক্রো-অর্থনীতির পাশাপাশি বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের দিকে সমানতালে নীতি-মনোযোগ দেওয়ায়। উন্নয়ন অভিযাত্রার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো এর অংশগ্রহণমূলক ধরন।
নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা– সব ক্ষেত্রেই সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি খাত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর সমবেত উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে। এক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণের ‘এনাবলিং এনভায়রনমেন্ট’ তৈরির কৃতিত্ব সরকারের। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন- আইএমএফ, এডিবি, বিশ্বব্যাংক, জাইকা ইত্যাদি) এ কারণেই বাংলাদেশের ওপর আস্থা রাখছে ধারাবাহিকভাবে। ইদানীং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা তাই বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার তালিকার ওপরের দিকেই রাখবে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে নিজেদের ঘাটতিগুলো পুষিয়ে নেওয়ার দিকেও নজর দেওয়া চাই। শুরুতেই আইএমএফের যে ঋণ সহায়তার কথা বলেছি, সে সহায়তার জন্য কিছু সংস্কারের শর্তও রয়েছে। ঋণ পাওয়ার শর্ত বলে নয়, বরং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে বেগবান ও টেকসই করার জন্য দরকারি সংস্কার কার্যক্রম হিসেবেই এগুলোকে দেখা উচিত।
এসব সংস্কারের প্রস্তাব বাজেট ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উপস্থাপন করা। বিশেষ করে কর কাঠামো এবং করনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সংস্কারের বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলো, আমাদের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত এখনো ৮ শতাংশের আশপাশে। আশপাশের দেশের এই অনুপাত এর দ্বিগুণের বেশি। প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেনÑ জোর জবরদস্তি করে নয়, সংস্কার করে উপযুক্ত জনসম্পদ ব্যবহার, মানুষকে উদ্বুদ্ধ এবং ‘ডিজিটাল আদায়’ পদ্ধতি চালু করে এই অনুপাত বাড়ানো সম্ভব। আইএমএফও একই সুরে কর-জিডিপি অনুপাত বছরে ০.৫ শতাংশ করে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। একইভাবে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতে চলমান ভর্তুকি কাঠামোও আজীবন চলতে পারে না। আমাদের মনের কথা। বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দাওয়াই এটি।
আর্থিক খাতকে আরও বাজারনির্ভর এবং এই খাতের শাসন পদ্ধতি উন্নয়নের যে শর্ত আইএমএফ দিয়েছে, তাও আমাদের ম্যাক্রো-অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়াবে। ব্যাংকের পুঁজি পুনঃভরণের মতো ‘বিলাসিতা’ করার সুযোগ আমাদের নেই। তাই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের টেকনিক্যাল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এ সংস্কারগুলো করা গেলে তা অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন কৌশলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক- বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.