
প্রসঙ্গ ইসলাম
পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করে যথাযথ মর্যাদা দানপূর্বক আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে রাখেন। কিছুদিন তিনি একাকীই ছিলেন সেখানে। অতঃপর পরওয়ার দিগার আল্লাহ তায়ালা আদমের (আ.) সঙ্গী হিসেবে হাওয়াকে (আ.) সৃষ্টি করলেন এবং উভয়কে বেহেস্তে বসবাসের আদেশ দিয়ে বললেন, এখানে তোমাদের যা ইচ্ছে ভোজন ও পান করবে। কিন্তু কদাচ একটি নির্দিষ্ট বৃক্ষের নিকটবর্তী হবে না। অনেকদিন ধরে অনাবিল সুখ-শান্তির মধ্যে আদম-হাওয়া (আ.) বেহেস্তে অবস্থান করেন এবং নিষিদ্ধ বৃক্ষের গাছ থেকে দূরে থাকেন।
কিন্তু আদমের সুখ-শান্তি দর্শনে ইবলিশ ঈর্ষানলে দগ্ধ হয়ে তাদেরকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করার জন্য নানা রূপে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ওই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেতে প্ররোচিত করে। শয়তানের দীর্ঘ দিনের চেষ্টার ফলে বিবি হাওয়া প্রথমে শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হন। তিনি শয়তানের প্ররোচনায় ওই বৃক্ষের ফল আহরণ করে প্রথমে স্বয়ং ভক্ষণ করেন এবং পরে হযরত আদমকে (আ.) খেতে অনুরোধ ও প্রলুব্ধ করেন।- (অবশ্য এ কথা কুরআনে নেই, বাইবেলে রয়েছে)। হযরত আদম প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও অবশেষে আদেশ বিস্মৃত ও হতবুদ্ধি হয়ে ওই ফল ভক্ষণ করেন।
ফলে তাদের অঙ্গ হতে বেহেস্তি পোশাক অপসৃত হতে থাকে। তারা লজ্জিত ও সংকোচিত হয়ে বৃক্ষপত্রে অঙ্গ আচ্ছাদন করেন। অতঃপর আদম (আ.) আল্লাহর দরবারে অপরাধ স্বীকার করেন। তাওবা করে নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রাথর্না করেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এও অবহিত করলেন যে, তোমার বংশধরদেরকে সামান্য সময়ের জন্য দুনিয়ায় অবস্থান করতে হবে। ওই সময়ে যারা আমার দেওয়া বিধান মোতাবেক জীবনযাপন করবে তাদের কোনো ভয়ের কারণ নেই।- (দ্র. সূরা বাকারা ৩৫-৩৯, আরাফ ১৯-২৫, ত্বাহা ১১৫-১২৩)।
উল্লেখ্য, আল্লাহ তায়ালার আদেশ বিস্মৃত হয়ে শয়তানের প্রবঞ্চনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার দরুন হযরত আদম-হাওয়া (আ.) তখনই বেহেস্ত হতে বিতাড়িত হয়ে ধরাতলে নিক্ষিপ্ত হন। কথিত আছে যে, হযরত আদম (আ.) সিংহলে (ভারতবর্ষে) এবং হাওয়া (আ.) ইয়ামেন প্রদেশে নির্বাসিত হয়েছিলেন। (আনোয়ারুল আম্বিয়া-১১, ইফা)। সাধারণ বর্ণনা মতে, আদম (আ.) সারণদ্বীপ (শ্রীলঙ্কা), হাওয়া (আ.) জিদ্দায় পতিত হয়েছিলেন এবং আরাফাতের ময়দানে আবার উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটেছিল।
আদম (আ.) যে দ্বীপে অবতরণ করেছিলেন ওই দ্বীপে একটি পর্বত আছে। পর্তুগীজরা এর নাম দেয় পিকে ডি আদাম বা আদমের পর্বত। বর্তমান শ্রীলঙ্কায় এটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থানও বটে। উপাখ্যান অনুযায়ী সেখানে একটি পাথরে আদমের (আ.) ৭০ ফুট দীর্ঘ পদচিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়।-(ই, বিশ্বকোষ ১/২৪৩)।
অনন্তর হযরত আদম (আ.) বহুদিন পর্যন্ত কারও কারও মতে প্রায় দু’শত বছর অনুতপ্ত ও দুঃখবিগলিত চিত্তে স্বীয় দোষত্রুটির জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আল্লাহ অসীম করুণায় তাদের ক্ষমা করেছেন। তারপর প্রিয়তম পতœী বিবি হাওয়ার সঙ্গে সুখে-দুঃখে সংসার জীবন অতিবাহিত করেন।
পূর্বে ধারণা এই ছিল যে, আদম (আ.) আরবি ভাষায় কথা বলতেন। ঐতিহাসিক হালাবীর মতে, আদম (আ.) জান্নাতে আরবি ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর তিনি সিরীয় ভাষায় কথা বলতেন। ইহুদি উপাখ্যান অনুযায়ী তাকে আগুনের ব্যবহার, কৃষিকাজ এবং কুটির শিল্প শিক্ষা দেওয়া হয়।-(তাবারি ১/১২৩)।
ইমাম কুরতুবী উল্লেখ করেন যে, আদম (আ.) যখন পৃথিবীতে অবতরণ করলেন তখন জিব্রাইল (আ.) জান্নাত থেকে কিছু গম, চাল ইত্যাদির বীজ এনে মাটিতে চাষ করার জন্য দিলেন এবং বললেনÑ যখন এগুলোর চারা গজাবে এবং দানা উৎপন্ন হবে তখন এগুলো কর্তন করুন এবং পিষে রুটি তৈরি করুন। ফেরেশতা এসব কাজের পদ্ধতিও প্রথম মানবকে বাতলে দেন। সেমতে আদম (আ.) রুটি তৈরি করে খেতে বসলেন। কিন্তু হাত থেকে রুটি খসে গিয়ে পাহাড়ের নিচে গড়িয়ে পড়ল। আদম (আ.) অনেক পরিশ্রমের পর রুটি কুড়িয়ে আনেন। তখন জিব্রাইল (আ.) বললেন, ‘হে আদম, আপনার এবং আপনার সন্তান-সন্তুতির রিজিক পৃথিবীতে এমনি পরিশ্রম ও কষ্টসহকারে অর্জিত হবে।’-(মারেফুল কুরআন, অখ- ৮৬৭)।
ঐতিহাসিক ইবনুল আছীরের বর্ণনা মতে, আল্লাহ আদমকে (আ.) পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণের নির্দেশ দেন এবং জিব্রাইল (আ.) তাকে হজের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেন। ঐতিহাসিক হালাবীর মতে, তিনি স্বাভাবিক জীবনের প্রয়োজনে দিরহাম এবং দিনার মুদ্রা ব্যবহার করতেন।
আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)Ñ এর প্রতিবার সন্তান জন্ম হতো জোড়ায় জোড়ায়। প্রতি জোড়ায় একজন ছেলে ও একজন মেয়ের জন্ম হতো। ইসলামী নিয়ম অনুসারে, ভাই বোনের মাঝে কখনো বিয়ে হয় না। সে হিসেবে এটিই হতো পৃথিবীর শেষ মানব প্রজন্ম। এরপর মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতো। কিন্তু এখানে তো পুরো মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। তাই বিশেষ একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে এর সমাধান করা হলো। যেহেতু একই জোড়ার ছেলে ও মেয়েরা পরস্পর বিয়ে করতে পারবে না তাই বিয়ে করতে হলে ভিন্ন জোড়ার কাউকে করতে হবে। কাবিল ও হাবিল ছিল ভিন্ন জোড়ার। সেজন্য তাদের ব্যাপারটি স্বাভাবিক নিয়মেই সমাধান হয়ে যায়। একজন আরেকজনের জোড়ার মেয়েকে বিয়ে করবে।
কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা দেয় সমস্যা। হাবিলের জোড়ার মেয়েটি তেমন সুন্দরী ছিল না। সেই তুলনায় কাবিলের জোড়ার মেয়েটি ছিল অনেক বেশি সুন্দরী। নিয়ম অনুসারে হাবিল অধিক সুন্দরী মেয়েটিকে পায় আর কাবিল পায় কম সুন্দরী মেয়েটিকে। কিন্তু কাবিল বেঁকে বসে, সে হাবিলের জোড়ার মেয়েটিকে বিয়ে করবে না। যেভাবেই হোক, নিজের জোড়ার সুন্দরী মেয়েটিকেই বিয়ে করবে। অনন্যোপায় হয়ে হযরত আদম (আ.) উভয় পুত্রকে কোরবানি প্রদান করতে আদেশ দেন। সে সঙ্গে এ কথাও বলে দেন যে, যার কোরবানি গৃহিত হবে সে-ই আকলিমাকে পত্নী রূপে পাবে।
তাওরাতে বর্ণিত আছে যে, কাবিল কৃষি কাজ করতেন, হাবিল পশুপাল চড়াতেন। কাবিল উৎপাদিত শস্য ও হাবিল ছাগল কোরবানি করেছিলেন। হাবিলের কোরবানি আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। তা দেখে কাবিল ক্রোধান্বিত হয়ে হাবিলকে হত্যা করেন। (জন্ম পুস্তক : ৪/৩-৫ পঙ্ক্তি)। কাবিল নিহত ভ্রাতার মৃত দেহ কিভাবে গোপন করবেন, তা নিয়ে বিপাকে পড়েন। তিনি যখন এ বিষয়ে কিছুই ভেবে স্থির করতে পারলেন না আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে মৃতদেহ কবরস্থ করার প্রণালী শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দুটি কাক প্রেরণ করেন। কাক দুটি হঠাৎ তুমুল ঝগড়ায় অবতীর্ণ হয়।
একপর্যায়ে একটি নিহত হয়। তখন হত্যাকারী কাকটি ঠোঁটে মাটি খুঁড়ে নিহত কাকটিকে প্রোথিত করে উড়ে যায়। তা দেখে কাবিল লজ্জিত হলেন এবং শিক্ষা নিলেন। তার পর তিনিও মাটি খনন করে হাবিলের মৃতদেহ দাফন করলেন। -(দ্র. সূরা মায়িদা ২৭-৩১)।
স্মরণযোগ্য যে, ইহুদি সাল অনুযায়ী ৬ নীসান শুক্রবার আদমকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়। একই দিনে তিনি জান্নাত হতে বহিষ্কৃত হন এবং একই তারিখে তার মৃত্যু হয়। তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ের পাদদেশে রত্ন গুহায় সমাহিত হন। (ইয়াকুবী ১/৫)। কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে হযরত আদম (আ.) হজ পালন, বংশ বিস্তার সম্পন্ন করে আবার ভারত বর্ষে ফিরে আসেন। তবে কোন্ মাটিতে তিনি শুয়ে আছেন তা এখনো গবেষণাধীন রয়েছে। হযরত আদম (আ.) প্রায় ৯৩০ বছর জীবিত ছিলেন। তার তৃতীয় পুত্রের নাম হযরত শীস (আ.)। পিতার অবর্তমানে তিনি সত্য প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। বাইবেলসহ বিভিন্ন গ্রন্থে আদমের (আ.) বংশধরদের একটি তালিকাও রয়েছে।-(দ্র. বাইবেল ৫ অধ্যায়, পঙ্ক্তি ও আনোয়ারে আম্বিয়া-১৭)। আদম সন্তানদের এ দুনিয়াবী জীবন ক্ষণস্থায়ী। শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে এ জীবনকে সফল করে তোলে চিরস্থায়ী জান্নাতের জন্য সুখ-শান্তির প্রয়াসই হোক সকলের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব