ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও দ্রব্যমূল্য

ইফতেখার আহমেদ খান

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ২ জুলাই ২০২৩

বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও দ্রব্যমূল্য

.

চলমান বিদ্যুৎ সংকট সমগ্র সমাজের সামগ্রিক ব্যবস্থায় বড় মাপের সমস্যার উদ্ভব ঘটিয়েছে। দেশের সব স্থানে বিদ্যুতের লাগামহীন ভোগান্তি যে কী মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে কি? গ্রাম এলাকায় সেচের কাজ, খামারির কাজ, বিদ্যুৎচালিত অন্যান্য উৎপাদনের কাজ, শহরের কলকারখানা, বসতিতে সুপেয় পানির উৎস, সর্বোপরি সমাগ্রিক জীবনধারায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব বয়ে এনেছে লোডশেডিং। ঢাকা শহরের পৌনে দুই কাঠা প্লটের বাড়িগুলোতে প্রতিটি তলায় দুটি ইউনিটের ভিতরটিতে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ছাড়া থাকে অন্ধকার। দিনের বেলায়ও সারাক্ষণ বিদ্যুৎবাতি ¦ালিয়ে রাখতে হয়।

সেই সব বাসাবাড়ি বর্তমান সময়ে বীভৎস তাপপ্রবাহে দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক পাখা বাতি ব্যতীত অবস্থায় ঘর্মাক্ত দেহমনে জীবনকে অহেতুক বিবেচনা করে ভীষণ হতাশায় মাথা নিচু করে হতাশা প্রকাশ করে। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক বাড়ির পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সেই সব বাসার মানুষ পানির দৈনন্দিন প্রয়োজন কী করে মেটায়, কী করে প্রাকৃতিক কাজ সমাধা করে, তা সহজেই অনুমেয়। একটি শহরের বাড়ির মানুষ পানির অভাবে বাথরুমে যেতে পারছে না এবং এটা বেশ কিছুদিন যাবৎ ঘটছে, এমন দুর্দশা কাম্য নয়। বেশ কিছু পরিবারকে দেখেছি, কী করে বাথরুম ব্যবহার করা যায় সে বিষয়ে নানা পরিকল্পনা করেও কোনো উপায় না পেয়ে শেষে পুরো পরিবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার সিন্ধান্ত নিয়েছে। পণ্যমূল্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ অসহায় হয়ে শূন্যপানে দৃষ্টি ফেলে। এটা তো কোনো সামন্তশাসন নয় যে, রাজার বিরুদ্ধে কিছু বললেই গলা কাটা যাবে! এটা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দেশের এরূপ অবস্থার জন্য সরকারকে জনজবাবদিহির আওতায় আনার দাবি রাখে। বিষয়টি তো এমন নয় যে, জনগণ বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করেনি বলে এরূপ হচ্ছে। বিদ্যুতের বিল প্রদানের সরকারি প্রবণতা এতটাই তীব্র যে, মানুষ বিদ্যুতের বিল না দিয়ে ভাত খেতে বসে না, না জানি ভাত খাওয়ার মাঝখানে বিদ্যুৎ চলে যায়!

অন্যদিকে, দ্রব্যমূল্যের চিত্রটি নাগরিকদের মনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। একটি উপাদান হলো বণ্টন সংকট। সাধারণ নাগরিকের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন এটা নয়, এটা নির্দ্বিধায় শোষণ বঞ্চনা। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ১৪ তে কৃষক শ্রমিকের মুক্তির কথা এভাবে বলা হয়েছে- রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে, কৃষক শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দান করা। অনুচ্ছেদ ১৫ এরধারায় বলা হয়েছে- রাষ্ট্র অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ, জনগণের বেঁচে থাকার সামগ্রিক শর্ত নির্মাণে রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। ধারাসমূহ খেয়াল করলে দেখা যায়, কৃষক-শ্রমিক এবং অনগ্রসর জনগণের কথা বলা হয়েছে। এখন যদি আমরা মিলিয়ে দেখি দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি বিদুৎ সংকটে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, নিঃসন্দেহে শহরের মধ্যবিত্ত চাকুরে শ্রেণি, শ্রমিক-কৃষক এবং অনগ্রসর অংশ। সুখ বলে একটি প্রত্যয় সমষ্টির মাঝে প্রতিষ্ঠার দাবি রাখে। সংকীর্ণভাবে এটা বলা যায়, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মতো মৌলিক প্রয়োজন ন্যূনতম মাত্রায়ও যদি পূরণ হয়, তবে বলা যায় মানুষ সুখে আছে। সরকারের তিনটি বিভাগ- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ বিচার বিভাগ। তিনটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং সমন্বয়হীনতার তীব্রতা যতটা পরিণাম বয়ে আনে, সেসবের মধ্যে অন্যতমটি হলো পরিচালন ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে দেয়া। এই ভঙ্গুরতাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ।

দ্রব্যমূল্য পরিবীক্ষণে সরকারের নির্দিষ্ট দপ্তর রয়েছে। সেই দপ্তর উদ্দিষ্ট ঘটনার কারণ বের করবে নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কার্য বিন্যাসে। এটি আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেকটাই অসম্ভব। কেননা, আমাদের প্রশাসনযন্ত্রের সুগঠিত প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেনি। প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও শাসন প্রাতিষ্ঠানিক হয়নি। এখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতার অসম বণ্টন এক বাস্তবতা। দেশের বেশিরভাগ মানুষই রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম ভাগ পায় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত নাগরিক সম্পদের ভাগ পায়। অপরদিকে যে জনতার দুর্বার শ্রমে কোষাগার পূর্ণ হয়, সেই জনতা তেমন কোনো বিনিময় পায় না। আয়ের সীমাহীন বৈষম্য, ধনী-গরিবের আকাশচুম্বী ব্যবধান, সুযোগের ব্যাপক তারতম্য, দুর্নীতির উল্লম্ফন ধারাবাহিকতা, দলীয়করণ শাসনতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা শাসন ব্যবস্থায় একটি বড় মাপের বণ্টন সংকটের উদ্ভব ঘটিয়েছে। উপাদানসমূহের সগৌরব উপস্থিতি স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলনীতিসমূহকে চ্যালেঞ্জ করে যায় প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সামরিক শাসন দীর্ঘদিন বলবৎ থাকায় নাগরিকবৃন্দ নিয়মতান্দ্রিক শাসন অনিয়মতান্ত্রিক শাসন সম্পর্কে ধারণার অধিকারী হয় না। স্বাধীনতা অব্যবহিতকাল ১৯৭৫ সাল থেকেই বাংলাদেশে অনিয়মতান্ত্রিক শাসন জারি হয় এবং এর ভয়ংকর প্রভাব বলয় তৈরি হয়। যার কারণে ১৯৯০ পরবর্তী সময় হতে পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও শাসনতান্ত্রিক বিন্যাসটি জনমুখী করা সম্ভব হয়নি। বাস্তবিকভাবে, উন্নয়নশীল দেশের বাস্তবতায় প্রশাসনিক জটিলতাসহ আরও নানা কারণে সরকার যথেষ্ট মাত্রায় জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে না। অর্থাৎ, সরকার জনগণের মাঝে কার্যকর অর্থবহ সংযোগ স্থাপিত হয়না। সরকারের সকল উন্নয়ন উদ্যোগ, নীতি এবং এসব বাস্তবায়নে জনউদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থাকেই বলা হয় জনগণের মাঝে সরকারের অনুপ্রবেশ তেমন নেই। বিধায় জনঅভিপ্রায় সরকার সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না।

দলীয় রাজনীতির চর্চায় নেতৃত্বশ্রেণির রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা ভোগ ন্যায্য সমাজের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে না।  একশ্র্রেণীর দুর্বৃত্তায়িত নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ জনগণ আগ্রহী হয় না। ফলে প্রতিবাদ জানানোর  মতো যথেষ্ট তথ্য প্রাপ্তি ঘটলেও জনঅংশগ্রহণের ভিত্তিতে শাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না। সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিদ্যুৎ সংকট তীব্রভাবে প্রশাসনিক জবাবদিহির আওতায় আনা যায়। জনগণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দাবি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। দলভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা আধুনিক রাজনীতির একটি পোক্ত শর্ত। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির চর্চা অনুশীলন এবং প্রবাহে সত্যিকার অর্থে সাধারণ জনগণের অভিপ্রায় অন্তর্ভুক্ত হয় না। যেমন, সরকার দলভিত্তিক সরকার, দল গঠিত হয় জনগণের সমবায়ে। সেই সূত্রে জনগণ দ্বারা গঠিত যে দল, সেটি কিন্তু সরকারের নিকট দাবি তুলছে না দ্রব্যমূল্য বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান বয়ে আনার জন্য। অথচ রাজনৈতিক দল মানে সমাজের বৃহত্তর অংশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা। বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্যে পারস্পরিক বিরুদ্ধাচরণ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় অর্জিত দর্শন বিপরীত দর্শনে নিপতিত হয়। একটা অংশ ব্যাপকভাবে জনজীবনে উৎসজাত, চেতনাজাত ঐতিহাসিক জাতীয় ঐক্যের স্ফুরণ ঘটায়। আরেকটা অংশ একইতালে কৃত্রিম জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করে তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।  যার মোকাবিলা করতে করতেই সরকারের সময় বয়ে যায়। জনগণের মৌলিক চাহিদার প্রয়োজন মেটানোর অতি আবশ্যক দিকটি থেকে যায় উপেক্ষিত।

লেখক : উন্নয়নকর্মী

[email protected]

×