ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সিসি ক্যামেরা

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ২ জুন ২০২৩

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সিসি ক্যামেরা

.

অপরাধীরা কোনো অপরাধ করার পূর্বে অপরাধ পূর্ববর্তী অপরাধ পরবর্তী খুঁটিনাটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েই অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। অপরাধী যদি বুঝতে পারে, অপরাধ সংঘটনের পরবর্তী সময়ে অপরাধকর্মের জন্য তাকে গ্রেফতার হতে হবে এবং উপযুক্ত শাস্তির নিশ্চয়তা রয়েছে, তাহলে অপরাধীরা নিরুৎসাহ বোধ করেন। অনেক সময় দেখা যায়, সিরিয়াস অপরাধ করেও জামিনে মুক্ত হয়ে একজন ক্রিমিনাল দেদার পূর্বের ন্যায় অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ একজন অপরাধী নিজে সংশোধন না হয়ে পুনরায় অপরাধকর্মে লিপ্ত হচ্ছে বিষয়টি অপরাধচক্রকে আরও ক্রিয়াশীল করে তোলে। কাজেই আমাদের এমন একটি সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে, যেখানে অপরাধীরা অপরাধ করার পূর্বে ভয়ে থাকতে বাধ্য হবে, পরবর্তীতে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে, এমন ব্যবস্থা দাঁড় করালেই অপরাধীরা অনেকাংশে অপরাধ প্রবণতা থেকে নিবৃত্ত হয়ে যাবে। আর যদি বারংবার অপরাধীকে জামিনে মুক্ত করে দেওয়া হণ্ড তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনায় অপরাধীদের নিবৃত্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করার পাশাপাশি দ্রুত বিচার নিষ্পত্তিতে কাজ করে যেতে হবে।

সময়ের আবেদনে কালের পরিক্রমায় অপরাধীরা ধূর্ত হয়ে উঠেছে, নতুন নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় নির্বিঘ্নে অপরাধকর্ম করে বেড়াচ্ছে অপরাধীরা। অপরাধীদের গ্রুপে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনায় দক্ষ কৌশলী জনবল থাকে, এই অংশটি অপরাধীদের নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে অপরাধ সংঘটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সিসিটিভিকে কিভাবে অকেজো করা যায়, সিকিউরিটি সার্ভিসের চোখ কিভাবে ফাঁকি দেওয়া যায়, কোন্ এলাকায় ঝুঁকি বেশি, কোন্ এলাকা অপরাধকর্মের জন্য নিরাপদ, ক্রাইম জোন এরিয়া প্রভৃতি তথ্য উপাত্ত জেনে বুঝে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনের দিকে ধাবিত হয়। সুতরাং এদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ রয়েছে, তৎসাপেক্ষে এদের মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশকেও আরও শক্তিশালী প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে বলীয়ান হতে হবে।

বাংলাদেশ পুলিশ অপরাধ প্রতিকার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সে সব উদ্যোগের সফলতাও পেয়েছে দেশের জনগণ। আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর তাগিদে নানাবিধ উদ্যোগ প্রকল্পের মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে বাহিনীটি। অনলাইনে নানাবিধ সেবা প্রদান করে জনগণের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে নতুনভাবে সংযোজিত বাহিনীটি জনগণের কাছাকাছি পৌঁছে প্রোঅ্যাকটিভ সার্ভিস প্রদানের কাজটি করে যাচ্ছে। প্রকৃতঅর্থে প্রতিনিয়ত পুলিশের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই বাহিনীকে কৌশলী বিচক্ষণ হতে হচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

অপরাধ দমন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা এই ধরনের প্রযুক্তির ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে অনেক অপরাধীকে শনাক্ত গ্রেপ্তার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই সঙ্গে রহস্যভেদ হয়েছে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলারও। প্রযুক্তিটির বহুবিধ ব্যবহারের কারণেই প্রাইভেটলি এটি বিভিন্ন পরিসরে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে স্থাপন করা এক হাজার ৬০০ সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে অসংখ্য চাঞ্চল্যকর, গুরুত্বপূর্ণ মামলাসহ নানা ধরনের অপরাধের রহস্য অনুসন্ধান অপরাধী গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনেকে প্রযুক্তির বিষয়ে অবগত হয়ে অপরাধ সংঘটনে ব্রতী হতে পারে না। অর্থাৎ বিষয়টি একটি প্রতিরোধমূলক ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। মাঝে মধ্যে দেখা যায়, অভিযুক্তরা অনেকেই পুলিশের নিকট আত্মসমর্পণ করছে। অর্থাৎ তারা যখন বুঝতে পারে, তাদের দিন ফুরিয়ে গেছে, ফেরারি আসামি হয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই, তখনই তারা আত্মসমর্পণের পথ খুঁজে নেয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের আট বিভাগে বেসরকারি পর্যায়ে আরও ৫০ হাজার সিসিটিভি বসানোর পরিকল্পনা করেছে পুলিশ। পুলিশ যেসব সিসিটিভি বসিয়েছে, তার মধ্যে অপরাধ দমন অপরাধী ধরতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) যুক্ত সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো রয়েছে। এসব সিসিটিভি অপরাধ করে অপরাধী পালানোর সময় এই ধরনের সিসিটিভি সংকেত দেবে। রাজধানী ঢাকার অপরাধ দমন, নিয়ন্ত্রণ নিরাপত্তায় সিসিটিভি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বিবেচনা করেই পরিকল্পনাটি পুলিশ হাতে নিয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে, বিশেষ করে ব্যস্ত রাস্তার মোড়, ইন্টারসেকশন, প্রবেশ-বাহির পথ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা- কেপিআই সংলগ্ন পয়েন্টে সিসিটিভি ক্যামেরা চালু রয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এমন পরিস্থিতিতে ক্রাইম ট্রাফিক মনিটরিং ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকার সার্বিক নিরাপত্তা আরও ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব ক্যামেরায় স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম, ফেস ডিটেকশন (চেহারা চিহ্নিতকরণ), গাড়ির নম্বর প্লেট চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তি বা এএনপিআরসহ অন্তত ১১ ধরনের সুবিধা পাওয়া সম্ভব হবে। এই পরিকল্পনার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, ডিজিটাল টহল নিশ্চিত করা। অর্থাৎ গভীর রাতেও নির্জন রাস্তা থাকবে পুলিশের নজরদারিতে।

ক্যামেরায় চেহারা শনাক্তের প্রযুক্তি থাকায় অপরাধী এবং পলাতক আসামিদের সহজেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। চুরি এবং ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করে কেউ পালিয়ে যাওয়ার সময় সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়লে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। ছাড়া থাকবে স্বয়ংক্রিয় শব্দ চিহ্নিতকরণ ব্যবস্থা। রাজধানীর কোথাও কোনো শব্দ হলে তাৎক্ষণিকভাবে শব্দের বিস্তারিত তথ্যসহ কন্ট্রোলরুমে সিগন্যাল চলে যাবে। ফলে, পুলিশের ভাষায়শূটিং ইনসিডেন্টবা গোলাগুলির ঘটনা ঘটলে দ্রুততম সময়ে তথ্য পাবে পুলিশ। এমনকি কত দূরে গুলি হয়েছে এবং কী ধরনের অস্ত্রের গুলি, তাও চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। ক্যামেরায় থাকবে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) যুক্ত সিসিটিভি প্রযুক্তি অপরাধীদের আগের অপরাধের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করবে। শুধু তাই নয়, স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানান দেবে অপরাধীর অবস্থান। এতে আধুনিক সফটওয়্যার সংযুক্ত রয়েছে। ফলে, সিসিটিভি ফুটেজ থেকেই অপরাধীর চেহারা শনাক্তসহ তার কোনো ডাটাবেজ থাকলে তা সহজেই বের করা যাবে। ক্যামেরাগুলো গাড়ির নম্বরের দিকেও খেয়াল রাখবে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে নম্বরপ্লেটের ছবি তুলে রাখতে পারবে। কাজেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ মেজারমেন্ট এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসা সম্ভব। ঢাকা শহরে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ফল সাপেক্ষে ঢাকার বাইরের সিটিতে ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো উচিত বলে মনে করছি।

পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে পুলিশি কার্যক্রমে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। পুলিশ যেন জনতার বিশ্বস্ত সঙ্গী হতে পারে সে জায়গাটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পুলিশের ইতিবাচক প্রয়োজনে জনতা যেন সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন করে সে জায়গায় আমাদের কাজ করে যেতে হবে। তাহলে পাবলিকের সঙ্গে পুলিশ বাহিনীর একটি সুসম্পর্কের ক্ষেত্র রচিত হবে। পুলিশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে বিভিন্ন দেশের পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মতামত মূল্যায়ন তুলে ধরেন। পাশাপাশি তাদের দেশের স্ট্রাকচার, ফাংশন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে থাকেন অর্থাৎ নলেজ শেয়ারিং হয়ে থাকে। কাজেই ধরনের জায়গা থেকে বাংলাদেশ পুলিশের লুপহোল সম্বন্ধে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে, পাশাপাশি পুলিশের আধুনিকীকরণের জন্য যে ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে সে বিষয়ে বিস্তর সাজেশন্স পাওয়া যাবে। লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×