ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

মে দিবসের আহ্বান: শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদার নবজাগরণ

সোহাইল আহমেদ

প্রকাশিত: ০০:৪৩, ১ মে ২০২৫

মে দিবসের আহ্বান: শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদার নবজাগরণ

১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেট আন্দোলনের মাধ্যমে যে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার পথপরিক্রমায় কেটে গেছে ১৩৬ বছর। উন্নয়ন ও সভ্যতার অপূর্ব অগ্রগতির মাঝেও আজও প্রশ্ন থেকে যায়-শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা, ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ কি সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?

শ্রম ছাড়া কোনো কিছুরই উৎপাদন সম্ভব নয়, এ সত্য সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু একটি শ্রমিক কত ঘণ্টা কাজ করবে? কতটুকু মজুরি পাবে? তার ও তার সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হবে? এইসব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজতে হয়। ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিকরা প্রথম যে দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন তা ছিল, "আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম, আট ঘণ্টা নিজের জন্য।" আট ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবির সঙ্গে ছিল একটি ন্যায্য মজুরির স্বপ্ন, যাতে তারা পরিবার নিয়ে সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারেন।

কিন্তু শ্রমিকের এই ন্যায্য দাবি শুরু থেকেই কঠোর দমন-পীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। মালিকপক্ষ ও সরকারের মিলিত প্রতিরোধের মুখে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়েছে, প্রাণ গেছে অসংখ্য শ্রমিকের। তারপরও, শ্রমিক আন্দোলন পিছিয়ে যায়নি। আট ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবি আজ বিশ্বের অনেক দেশে আইনি স্বীকৃতি পেলেও এখনো অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয়নি।

বিশেষ করে করোনাকালের অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে-দেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকার কতটা ভঙ্গুর! তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের কথাই ধরা যাক-প্রতিদিনই কেউ না কেউ বেতনের দাবিতে মিছিল করছেন, বিক্ষোভ করছেন। অথচ, বাংলাদেশের মতো দেশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বেশ ঘটা করে পালিত হয়; জাতীয় ছুটি থাকে; সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রার আয়োজন হয়। কিন্তু শ্রমিক সমাজের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন কতটা হয়, সে প্রশ্ন আজও থেকেই যায়।

আমাদের সমাজে এখনো শ্রমিকদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শিত হয় না। কর্মক্ষেত্রে, গণপরিবহনে, বাজারে-কোথাও শ্রমিককে মানুষ হিসেবে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয় না। এখনো আমরা মানুষের পোশাক বা বাহ্যিক আর্থিক অবস্থা দেখে তার মূল্যায়ন করি। অথচ, কলকারখানার ভেতর ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো, বিশেষ করে পোশাক শিল্পের বড় বড় দুর্ঘটনা, আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে।
অন্যদিকে, মজুরি ক্ষেত্রেও শ্রমিকরা অত্যন্ত আশাহত। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের বড় বড় পোশাক কোম্পানির সিইওরা চার দিনে যত আয় করেন, বাংলাদেশের একজন নারী শ্রমিকের সারা জীবনের আয়ও তার সমান হয় না। এটি কেবল বৈষম্যের নয়, নির্মমতারও প্রতিচ্ছবি।

মে দিবসের ইতিহাসও সংগ্রামী। ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে সমবেত হয়েছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক। এক অজ্ঞাত বোমা বিস্ফোরণের পর পুলিশ গুলি চালায়, প্রাণ হারান বহু শ্রমিক ও পুলিশ। তাদের আত্মত্যাগের স্মরণে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে রেমন্ড লভিনে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব রাখেন, যা ১৮৯১ সালে দ্বিতীয় কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপর থেকে বিশ্বজুড়ে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।

বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মে দিবসের তাৎপর্য আরও গভীর। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা ইত্যাদি দেশে সামরিক কুচকাওয়াজসহ বিশাল কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই ১ মে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত এবং নানা অনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। ভারতেও ১৯২৩ সাল থেকে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় মে মাসের পরিবর্তে সেপ্টেম্বর মাসে শ্রমিক দিবস পালিত হয়। এর পেছনে রয়েছে ১৮৮৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের সিদ্ধান্ত, যিনি মনে করতেন ১ মে উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশ নতুন করে সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।

বাংলাদেশের শ্রমআইন ২০০৬-এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তার কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-কর্মস্থলের পরিচ্ছন্নতা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা, অগ্নি নিরাপত্তা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম, স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি। শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়োগকর্তার দায়িত্ব হলেও, সরবরাহকৃত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করা শ্রমিকেরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

এছাড়া, নিয়োগকর্তাকে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কর্মরত শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়। শ্রমিকের শারীরিক অক্ষমতা দেখা দিলে তাকে সেই কাজে নিয়োজিত রাখা যাবে না। এসব ব্যবস্থার তদারকিতে শ্রম পরিদর্শকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আজকের দিনে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থা আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে। বর্তমান সরকার শ্রমিকবান্ধব নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখনো অনেক পথ বাকি।

একটি দেশের উন্নয়নের পেছনে শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের অবদান অনস্বীকার্য। যে শ্রমে দেশের প্রতিটি ইট-পাথর দাঁড়িয়ে, যে ঘামে আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মিত হয়, সে শ্রমিককে তার যথার্থ সম্মান ও অধিকার প্রদান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সুতরাং, আজকের মে দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক-শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা, তাদের জন্য নিরাপদ ও মানবিক কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা এবং সমাজে শ্রমিকের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রতিষ্ঠা করা। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সত্যিকার শ্রমিক বান্ধব সমাজ ও শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

সোহাইল আহমেদ
গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক।

রাজু

×

শীর্ষ সংবাদ:

যেই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে: আমীর খসরু
জামায়াত নেতারা রাজাকার হলে পাকিস্তানে গাড়ি বাড়ি থাকতো : শামীম সাঈদী
এনসিপির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা নেই- উমামা ফাতেমা
‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলমান
ইয়েমেনে হামলা চালিয়েই সাগরে ডুবে গেল মার্কিন সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান
জামিন পেলেননা তারেক রহমানের খালাতো ভাই তুহিন
লন্ডনে আজ আর্সেনাল পিএসজি মহারণ
১৭ অভিনয়শিল্পীর নামে মামলা, তালিকায় আছেন নুসরাত ফারিয়া-অপু বিশ্বাস-ভাবনাসহ অনেকেই
১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ডের ১১৯তম ড্র অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল
স্বর্ণের দাম, রেকর্ড উচ্চতা থেকে পতনের পথে
কুমিল্লায় পুলিশ-সেনাবাহিনীর চাকরির নামে প্রতারণা: দালালসহ ১৩ জন গ্রেফতার
১২ বছর বয়সী ছেলে শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগে ৩ মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার