
দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েল ছিল মধ্যপ্রাচ্যের এক অজেয় শক্তির প্রতীক। বিশ্বের অন্যতম পরমাণু ক্ষমতাধর দেশ, প্রযুক্তিগতভাবে সুসজ্জিত সেনাবাহিনী, দৃঢ় গোয়েন্দা তৎপরতা, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থনে গঠিত এই রাষ্ট্রটিকে ঘিরে ছিল এক ‘অজেয়তার আভা’।
কিন্তু সাম্প্রতিক যুদ্ধের বাস্তবতায় এই মিথ যেন ভেঙে পড়েছে। একদিকে হামাসের চমকপ্রদ হামলা, অন্যদিকে ইরানের সরাসরি প্রতিরোধ—সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ইসরায়েল আর সেই অজেয় শক্তি নয়, বরং একটি সাধারণ রাষ্ট্র, যার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ থেকেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল যে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ফাঁক আছে। এবার তা হাতেনাতে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘Iron Dome’ ও ‘David's Sling’—ব্যাপক চাপের মুখে ব্যর্থ হয়েছে বহু জায়গায়। ইরানের ছোঁড়া ১৫০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোনের একটা অংশ সফলভাবে আঘাত হানে, বিশেষ করে বীরশেবা ও হাইফায়। গোয়েন্দা নজরদারি শক্তিশালী হলেও, প্রতিরোধে ঘাটতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ:
ইসরায়েলে নিহত ২৮, আহত প্রায় ১,০০০+, তেলআবিব, বীরশেবা ও অন্যান্য শহরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে প্রচুর বেসামরিক লোকের ক্ষতি হয়েছে। শুধুমাত্র ১২ দিনের আক্রমণে ইসরায়েলে ক্ষয়ক্ষতির খরচ দাঁড়িয়েছে নি.স. ৪.৫ বিলিয়ন (যা পর্যন্ত হবে ৫ বিলিয়ন)—দুইটি কয়েকবারের তুলনায় দ্বিগুণ, যা ইরানের সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে এসেছে।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রায় ৩৯ হাজার ক্ষতিপূরণ দাবি জমা পড়েছে। ইসরায়েলের জনপ্রিয় পত্রিকা ইয়েদিয়থ আহারোনোথ জানিয়েছে, গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত শুরু হওয়ার পর দেশটির ট্যাক্স অথরিটির অধীনে থাকা ক্ষতিপূরণ তহবিলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার ৭০০টি দাবি নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে ভবনের ক্ষতির জন্য ৩০ হাজার ৮০৯টি, যানবাহনের ক্ষতির জন্য ৩ হাজার ৭১৩টি এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রীর ক্ষতির জন্য ৪ হাজার ৮৫টি ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। পত্রিকাটি আরও জানিয়েছে, “অনুমান করা হচ্ছে আরও হাজারো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেগুলোর জন্য এখনো কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি জমা দেওয়া হয়নি।
আন্তঃবিভাগীয় দুর্বলতা, নেতৃত্ব সংকট ও বিভাজন!
যুদ্ধে শুধু অস্ত্র নয়, নেতৃত্বও বড় শক্তি। কিন্তু নেতানিয়াহু সরকারের কৌশল ও যুদ্ধব্যবস্থাপনা জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিজে যুদ্ধ নীতির কেন্দ্রবিন্দু হলেও, দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলছে তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।
সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রিজার্ভ সেনা পর্যন্ত ‘লড়াইয়ের ক্লান্তি’ অনুভব করছে। জনগণ প্রশ্ন করছে—“এই যুদ্ধ আমাদের নিরাপদ করেছে নাকি বিপন্ন?” অনেকে রিজার্ভ কল প্রত্যাখ্যান করেছে, বিশেষ করে গাজা বা ইরানের যুদ্ধ নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে
অর্থনৈতিক চাপ বেড়েছে, জনগণের আস্থা কমছে।
পার্লামেন্টে বিরোধী দল যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে। সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ স্পষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইসরায়েল অচল!
মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ইসরায়েল যতটা শক্তিশালী, তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অনমনীয় সমর্থন। অস্ত্র, প্রযুক্তি, গোয়েন্দা সহযোগিতা, জাতিসংঘে ভেটো — সবখানেই আমেরিকাই ছিল ইসরায়েলের ঢাল।
প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি: Iron Dome, Arrow 3 – সবই আমেরিকান সহায়তায় নির্মিত।
আর্থিক সহায়তা: বছরে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জাতিসংঘে ভেটো: ফিলিস্তিন বা ইরান ইস্যুতে প্রায় সব রেজুলুশনেই আমেরিকার ভেটো।
গোয়েন্দা তথ্য: সিআইএ ও এনএসএ-এর সাথে গভীর সমন্বয়।
সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে একটি সত্য আরও উন্মোচিত হলো — ওয়াশিংটনের অনুমতি ছাড়া তেলআবিব যেন নড়াচড়া করতে পারে না।
ইসরায়েল সারা বিশ্ব জুড়ে যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিল "we are untouchable"—তা ভেঙে গেছে। এই যুদ্ধ ইসরায়েলকে শুধু সামরিকভাবে না, রাজনৈতিকভাবে, নৈতিকভাবে এবং কূটনৈতিকভাবে আঘাত করেছে। এখন প্রতিপক্ষ সাহসী, প্রযুক্তি–দক্ষ, কৌশলী। সামরিক সক্ষমতার চেয়েও বড় শক্তি হলো—বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব, নৈতিক অবস্থান এবং সঠিক গোয়েন্দা প্রস্তুতি। এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছে 'অজেয়' কথাটা এখন কেবল ইতিহাসের অংশ, বাস্তবতাটা হলো—ইসরায়েল এখন এক সীমাবদ্ধ রাষ্ট্র, যাকে টিকে থাকতে হলে কৌশল, নেতৃত্ব এবং নৈতিকতার জায়গায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
Jahan