ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

মন্দিরের গ্রাম খ্যাত নন্দীগ্রামের ‘নন্দীরহাট’

ইউনুস মিয়া, নিজস্ব সংবাদদাতা, ফটিকছড়ি

প্রকাশিত: ১০:২৮, ১ মে ২০২৫

মন্দিরের গ্রাম খ্যাত নন্দীগ্রামের ‘নন্দীরহাট’

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মন্দিরের গ্রাম হিসেবে খ্যাত নন্দীগ্রামের নন্দীরহাট। এখানে বৃটিশ শাসনামলের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি। জমিদারির বিত্ত-বৈভব প্রদর্শনের জন্য নির্মিত এই বাড়ি বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলেও সেই অতীত জৌলুস আর নেই। এই জমিদারী কিংবা জমিদার বাড়ির কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে যেন এক রূপ কথার গল্প।

নন্দীরহাটকে মন্দিরের গ্রাম বলা হয়। ব্রিটিশ আমলে নন্দীরহাটে ছিলেন কয়েকজন জমিদার, তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতেই ছিল বড় বড় মন্দির। সেসব মন্দির এখনো কালের গর্ভে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। এখনো টিকে আছে লক্ষ্মীচরণ সাহা, নন্দীবাড়ি, সেনবাড়ি, রক্ষিতবাড়িসহ আরো নাম না জানা অনেক জমিদারবাড়ির মন্দির। জায়গাটির নাম নন্দীবাড়ির নামেই নন্দীর ঘাট হয়েছে।

 নন্দীরহাট বাজারের রাস্তার পাশে প্রাচীন মগধেশ্বরী মায়ের মন্দির, এরপর বাজারের দুই পাশে রয়েছে অতিপ্রাচীন দুই মন্দির : রাস্তার বাঁ পাশে শ্রীশ্রী জগন্নাথ মন্দির আর ডান পাশে নিস্তারানী মায়ের কালীবাড়ি মন্দির, যার দেখাশোনা করতেন নন্দীবাড়ির লোকজন ।
নিস্তারানী কালীবাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার নিহারপুড় গ্রাম, সেখানে রয়েছে আরো দুটি মন্দির : একটি শ্রীশ্রী বাসুদেব সেবা আশ্রম, পাশেই দুর্গাবাড়ি। 

নন্দীরহাট বাজারে বাঁ পাশে একুশে পদক পাওয়া, সুরকার ও সংগীত পরিচালক সত্য সাহা সড়ক দিয়ে একটু ভেতরে গেলে চোখে পড়বে শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুরের মন্দির। এর পাশে পুকুরপাড়ে শ্মশানঘাট এলাকা। এর একটু পর সাহাপাড়া, ১৫০ বছরের পুরোনো মন্দিরটি এখানে, নাম শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউর মন্দির, যা ধর্মঘর নামে পরিচিত। এর একটু পরে বৈষ্ণব বাড়ি রয়েছে, শ্রীশ্রী রঘুনাথ গোস্বামী সমাধি মন্দির নামে, তার পরে ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মীচরণ সাহার জমিদারবাড়ি, যা সত্য সাহা বাড়ি নামে পরিচিত। এই বাড়িতে একসঙ্গে তিনটি মন্দির : প্রথমটি শ্রীরাধাকৃষ্ণ মন্দির, পাশে শ্রীলক্ষ্মী মন্দির, এরপর পারিবারিক শ্রীদুর্গামন্দির। প্রতিবছর সব পূজাই হয়ে থাকে এই বাড়িতে।

ফতেয়াবাদ  জংশনের পাশে নাগবাড়ি ও দাশবাড়িরও রয়েছে নিজেদের কালীবাড়ি। ফতেয়াবাদ জংশন ফেলে গেলে চোখে পড়বে শ্রীশ্রী লোকনাথ বাবা সেবা আশ্রম (চট্টগ্রাম কেন্দ্র)। এই মন্দিরটি সারা বাংলাদেশে সুপরিচিত। এই মন্দিরের পাশে আরো দুটি মন্দির আছে, একটা শিবমন্দির আর একটি বিষ্ণু মন্দির ।

এরপর ব্রাহ্মণপাড়া যেতে পড়বে শ্রীশ্রী তিননাথ মন্দির। এর একটু পরে প্রাচীন শ্রীশ্রী গোপাল জিউর মন্দির, এই মন্দিরে যেতে যেতে চোখে পড়বে শ্রীমদধেশ্বরী মায়ের মন্দির। এগুলো শেষ করে শৈলবালা স্কুলের রাস্তা ধরে আসার সময় চোখে পড়বে নতুন তৈরি হওয়া শ্রীশ্রী রামঠাকুরে

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব কিংবা এই সব পুরনো ঐতিহ্য সংরক্ষণে পুরাকীর্তি বিভাগের সুদৃষ্টির অভাবে আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে এই ঐতিহাসিক নিদর্শন।জমিদারি ইতিহাস ঐতিহ্য, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহার সামাদি আর স্থাপত্যে ঐতিহ্যে অতুলনীয়তার কারণে বর্তমানে এই জমিদারি বাড়ি ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে দিন দিন আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠেছে।

বৃটিশ আমলে এই গ্রামে বেশ কয়েকজন জমিদার বসবাস করতেন। জমিদারদের রাজবাড়ির পাশাপাশি ছিল তাদের তৈরি নানা মন্দির। সে কারণেই এ গ্রামকে মন্দিরের গ্রাম হিসেবে অভিহিত করা হয়। আর এ নন্দীরহাট গ্রামের একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি লক্ষ্মীচরণ সাহার জমিদার বাড়ি। এ জমিদার বাড়িটি সত্য সাহার জমিদার বাড়ি হিসেবেও পরিচিত। প্রায় ৫ একর জায়গার উপর দুই গম্বুজ বিশিষ্ট এ জমিদার বাড়ি নির্মিত হয় ১৮৯০ সালে।

জমিদার শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহা বাড়িটি নির্মাণ করেন। জমিদার লক্ষ্মীচরণ সাহা, মাদল সাহা ও নিশিকান্ত সাহা এ জমিদারীর সূচনা করেন। পরে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত জমিদারী দেখাশোনা করেন লক্ষ্মীচরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন সাহা। ১৯৩৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সত্য সাহার জন্ম হয় এ জমিদার বংশে। একুশে পদক প্রাপ্ত খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক ও সুরকার সত্য সাহার নামেই এখন জমিদার বাড়িটি পরিচিত। ঐতিহাসিক এ বাড়িটিতে এক সময় সিনেমার শুটিং ও হয় একুশে পদক প্রাপ্ত খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক ও সুরকার সত্য সাহার প্রযোজনায় ১৯৭৫ সালে ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার দৃশ্য ধারণ চলে এ রাজবাড়িতে। সত্য সাহারা ছিল ১২ ভাই। এ বাড়িতে প্রায় ১শ’ কর্মচারী ছিল। প্রাচীন ঐতিহ্য সম্বলিত এই বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। বাড়িটির চারদিকে রয়েছে ফসলি জমি, গাছগাছালি ও তিনটি পুকুর। এ ছাড়া আছে একটি দোতলা কাচারি ঘর, একটি বিগ্রহ মন্দির ও দুইটি বাসভবন। দৃষ্টিনন্দন এ জমিদার বাড়িটি কালের প্রবাহে জরাজীর্ণ হলেও এর ভাবগম্ভীর ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য এখনো বিদ্যমান। জমিদার ভবনের দেয়াল ও কার্নিশগুলো নানা কারুকাজে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। কাঠের ছাদের বাড়িটির দুই পাশে আছে দুটি গম্বুজ।

লক্ষ্মীচরণ সাহার বংশধর ননী গোপাল সাহা জানান, এই বাড়ির ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। ১৯২০ সালে জমিদার লক্ষ্মীচরণ সাহা, মাগল সাহা ও নিশি কান্ত সাহা এই তিন ভাইয়ের হাত ধরে শুরু হয়েছিল জমিদারি প্রথা। হাটহাজারী উপজেলার বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল তাদের জমিদারী। এসব অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার কৃষক প্রতিবছর খাজনা দিতে আসত এই বাড়িতে। নিয়মিত রাজ পূণ্যাহ অনুষ্ঠান হতো। জমিদার প্রসন্ন কুমার সাহার ছিল দুটি ঘোড়ার গাড়ি। তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আদালত ভবনে যেতেন। দুজন নেপালী দারোয়ান সবসময় তার সঙ্গে থাকত। চাকর-বাকর ছিল অর্ধশতাধিক। ছিল নয় জোড়া হালের গরু। ছিল গোলা ভরা ধান আর পুুকুর ভরা মাছ। একেক বেলায় রান্না হত প্রায় দু-তিনশ' লোকের। কিন্তু কালের বিবর্তনে লক্ষ্মীচরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন কুমার সাহার হাতে ধরে এই বিস্তৃত জমিদারীর ইতি ঘটে। ইতিহাস ঐতিহ্য বিবেচনায় এই বাড়ি হতে পারে পুরাকীর্তি বিভাগের এক অমূল্য সম্পদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট বাংলার ইতিহাসকে তুলে ধরতে এই ঐতিহাসিক নিদর্শন লক্ষ্মীচরণ সাহার জমিদার বাড়ি সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন এলাকাবাসী।

নুসরাত

×

শীর্ষ সংবাদ:

যেই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে: আমীর খসরু
জামায়াত নেতারা রাজাকার হলে পাকিস্তানে গাড়ি বাড়ি থাকতো : শামীম সাঈদী
এনসিপির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা নেই- উমামা ফাতেমা
‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলমান
ইয়েমেনে হামলা চালিয়েই সাগরে ডুবে গেল মার্কিন সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান
জামিন পেলেননা তারেক রহমানের খালাতো ভাই তুহিন
লন্ডনে আজ আর্সেনাল পিএসজি মহারণ
১৭ অভিনয়শিল্পীর নামে মামলা, তালিকায় আছেন নুসরাত ফারিয়া-অপু বিশ্বাস-ভাবনাসহ অনেকেই
১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ডের ১১৯তম ড্র অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল
স্বর্ণের দাম, রেকর্ড উচ্চতা থেকে পতনের পথে
কুমিল্লায় পুলিশ-সেনাবাহিনীর চাকরির নামে প্রতারণা: দালালসহ ১৩ জন গ্রেফতার
১২ বছর বয়সী ছেলে শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগে ৩ মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার