ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

নোবলেরে দশে থকেে

প্রবাসে অবিনাশী মৃত্যুর বেদনা

দলেওয়ার হোসনে

প্রকাশিত: ২১:০৭, ১৮ মে ২০২৩

প্রবাসে অবিনাশী মৃত্যুর বেদনা

জন্মিলে মরিতে হইবে- এই প্রবচন আমরা হরহামেশাই মুখে আওড়াই

জন্মিলে মরিতে হইবে- এই প্রবচন আমরা হরহামেশাই মুখে আওড়াই। মৃত্যু যে সবারই অনিবার্য, তা না মানার মতো বেকুব লোক দুনিয়াতে নেই। কারও মৃত্যুতে আমাদের সমাজ সংসারে জীবিত অন্য কারও জীবন থেমে থাকে না। তবে অনেক ক্ষেত্রে বেদনাটা হয় দুর্বহ। স্বাভাবিক জীবন যাত্রা হয়  ক্লেশকর। কষ্টের সীমা বাড়ায় যাতনা, সংকট ও নানামুখী প্রবঞ্চনা। তারপরেও এসবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় মানুষকে।
জীবনে এমন কিছু প্রিয়জনের মৃত্যুর অবিনাশী ও তীব্র শোক কারও কারও জীবনকে বেদনার এমন অতল সাগরে ডুবিয়ে দেয়, যার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় আমৃত্যু। জীবনে দেখা এমন অতিপ্রিয়  কয়েকজনের অকাল মৃত্যুর কষ্ট যেন আমার নিঃশ্বাসের গ্রন্থিকে চেপে ধরে আছে আয়ুস্কাল জুড়ে। প্রবাসী হলে এই কষ্টÑবেদনা কতটা তীব্র, স্থায়ী ও দুর্বিষহ হয় তা কেবল ভুক্তভোগী প্রবাসীরই জানা। সেখানকার নিঃসঙ্গ জীবনে কষ্ট ভুলে থাকার কিংবা স্মৃতি বিস্মৃত হবার ফাঁক ফোকর নেই কোনোখানে। তাই আমি আজও ভুলিনি অনেক মর্মন্তুদ বেদনার মধ্যে অকালে এক মুকুল ঝরার স্মৃতি।
আমাদের সাত ভাইয়ের মধ্যে আমার অবস্থান চতুর্থ। যার অবস্থান ছিল ষষ্ঠ, তার নাম মুকুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার পর উচ্চ শিক্ষার্থে স্টকহোমের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওকে এডমিশন করালাম। আসার দিন তারিখ ঠিক ১২ মে। আমিও ওর আসার আনন্দে ব্যতিব্যস্ত। ভাইটির আর আসা হলো না। সামান্য জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে তিন দিনের মাথায় সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে মাত্র ২৭ বছর বয়সে। যার যাবার কথা ছিল সবার শেষে, সে চলে গেল সবার আগেÑ এ যেন পিতার কাঁধে সন্তানের ভারী লাশ! 
প্রবাস জীবনে এই প্রথম বুঝলাম নিষ্ঠুর বেদনার ভার কতটা দুর্বহ ও অবিনাশী। বুকের ভেতর রক্তক্ষরণের এই ক্ষত জীবনকে করে তোলে কাতর। এ বেদনাকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা যায় না। পাথর ভেদ করে উথলে ওঠে সেই বেদনা। এতটাই শক্তিশালী সেই বেদনার ঊর্ধ্ব চাপ। নির্জন-নিঃসঙ্গ এই প্রবাসে এভাবে বেদনাই থাকে আমাদের চিরসঙ্গী।
আরেকটি বেদনা আমাকে আঘাত করে ১৯৮৯ সালে। এ বছর আমি হারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের তরুণ ও সুদর্শন শিক্ষক ড. আহসানুল হাবীবকে। যার সঙ্গে আমার গড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক। তার উপস্থাপনায় বিটিভি ও রেডিও বাংলাদেশের কয়েকটি নিয়মিত অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম তার প্রিয় আস্থাভাজন সহকারী। শুধু তার ছাত্র নয়, সব প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ছাপিয়ে আমাদের সম্পর্কটা হয়ে উঠেছিল বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের সম্পর্কের বন্ধন বৃত্তে মজবুতভাবে আবদ্ধ।

তিনিও অকস্মাৎ একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের টিএসসি চত্বরের সামনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় অকালেই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে যান পরপারে। সেই ঘটনায় ঐদিন আমি এতটাই স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম যে, শোকে, কষ্টে, বেদনায় আর স্যারের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার মানসিক শক্তি পাইনি। আমি আজও ভুলিনি প্রিয় স্যারকে।  
আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা না লিখলেই নয়। যার নাম বিশ্ব বাঙালির কাছে কম-বেশি সুপরিচিত। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ কাঁপানো সুইডেন প্রবাসী দুঃসাহসী বজ্রকণ্ঠ শহীদুল হক মামা ছিলেন সুইডেনে আমার প্রতিবেশী। ৭১ সালে রণাঙ্গনে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন অসীম সাহসিকতার সঙ্গে গেরিলা মামা বাহিনীর প্রধান হিসেবে। সম্পর্কটা ছিল এতটাই মধুর ও অকৃত্রিম যে, তার বসবাস ছিল যেন আমার আত্মার ভেতর। তার বাড়িতে, বাইরে নিয়মিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, খানাপিনায় কেটে যেত দিন কিংবা রাত। টেলিফোনে কেটে যেত গোটা রাত। তার সেই স্মৃতির কথা লিখতে গেলে লিখতে হবে একটি বিশালাকারের বই। তাকেও হারালাম। নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভোলা যাবে না তাকে।
জীবন এমনিতেই সংক্ষিপ্ত। এক জীবনে কজনকে পাওয়া যায় কাক্সিক্ষত সুহৃদ, বন্ধু, স্বজন বা মনের মতো মানুষ হিসেবে? থাকলে হাতে গোনা দুই চারজন কিংবা কারও জীবনে হয়তো এমন একজনেরও অস্তিত্ব থাকে না। সেই দুর্ভাগা জীবনে-দুর্লভ তারা ভরা আকাশ থেকে যদি একটি তারা খসে যায়, তার ক্ষতি কতটা বিশাল ও অপূরণীয়, তা জানে কেবল ভুক্তভোগী। সেই অভিজ্ঞতার স্বাদ আরেকবার নিতে হলো আমাকে।
 কদিন যাবত ভাবছিলাম- মুক্তা ভাই ফোন করে না কেন? প্রতিদিন একবার ফোন হাতে নিয়েও আবার রেখে দেই মিথ্যাভিমানে। না থাক। আমি আর কত করব? উনার কি একটিবারও মনে পড়ে না আমার কথা? আবার পরক্ষণেই ভেবেছি, আমি  খামোখাই কেন এই আত্মাভিমান নিয়ে বসে আছি? ব্যস্ততা, শরীর খারাপ থেকে শুরু করে কত কারণই তো থাকতে পারে!
এছাড়া প্রবাসীরা দেশ, মা, মাটি, বন্ধু ও স্বজন বিচ্ছিন্ন বলেÑ মরু প্রান্তরের মতো নিঃসঙ্গতা ও হাহাকার বোধ থেকে যতটা  অনুভূতি প্রবণ হয়, ততোটা  দেশে থেকে কেউ হয় না। 
এই সত্যটা বুঝলেই আর কষ্ট ও অনুযোগ মনের ভেতর বাসা বাঁধে না। তাই সত্যটা মেনে নিয়ে বারবার মুক্তা ভাইকে ফোন করেছি সুদূর বগুড়ায়। একজন প্রবাসীর জন্য এই একটু সংযোগ- দুটো কথা বলার স্বস্তি মনকে দেয় অফুরান সজীব ও উৎফুল্ল অনুভূতি। এটাই একজন নিঃসঙ্গ প্রবাসীর চিত্তের বিনোদন। টেলিফোনটাই তার প্রবাস জীবনের  লাইফ লাইন।
কদিন মুক্তা ভাইয়ের সঙ্গে কথা না হওয়ায় মনটা বেশ অস্থির হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিনের মতো মাঝরাতে বসলাম ফেসবুকে। প্রথমেই দেখি মুক্তা ভাইয়ের এক বিষণœ ছবি। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-সহচর লাবলু ভাই দিয়েছেন পোস্টটি। পড়ে দেখি মুক্তা ভাই আর নেই এ পৃথিবীতে। চলে গেছেন না ফেরার দেশে  ১০ মে। অর্থাৎ দুদিন আগে। এ কেমন নিষ্ঠুর বজ্রাঘাত! বার বার পড়ছি এই ভেবে এটা কোন ভুল ব্যক্তির নাম-ধাম ও ছবি নয় তো? মুক্তা নামে তিনি আমার কাছে যেমন ব্রান্ডেড, তেমন আমিরুল মোমিন নামে নন। তাই বার বার পড়ে ভুল সাব্যস্ত করতে চেয়েছি সংবাদটি। ফোন করতে চেয়েও ভাবলামÑ এখন বাংলাদেশে গভীর রাত। থাক।
যখন স্নায়ুর প্রতিটি শিরা-উপশিরা একযোগে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল, তখন বুঝলাম- আমি ইন্দ্রজালের ভেতর নই। আছি মহাসত্যের নিষ্ঠুর জগতে। এখানে মৃত্যু হানা দেয় এভাবেই, যখন-তখন, কোন নোটিস ছাড়াই।


স্টকহোম ১৭ মে, ২০২৩

লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক

[email protected]

×