ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে করণীয়

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ২৯ মার্চ ২০২৩

ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে করণীয়

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসছে

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসছে। পণ্য রপ্তানি বাড়ছে বাংলাদেশ থেকে। দীর্ঘ সময় হয়ে গেল পাটের ওপর ভারত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। অনেক জায়গা থেকে তাদের অনুরোধও করা হয়েছে এটা তুলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তুলে নেওয়া হয়নি। এটা শুধু বাংলাদেশের ওপর না, যারা পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে, যেমন- নেপালের ওপরও এটা আরোপ করা হয়েছে। এটা মোকাবিলা করার জন্য যারা পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানিকারক বা প্রস্তুতকারক, তাদের হিসাবরক্ষণের স্বচ্ছতা লাগবে। এটাকে যদি আমরা ডিজবার্স সেটেলমেন্টে নিতে চাই, তার জন্য আমাদের রপ্তানিকারকরা যে ডাম্প করছে না, তার প্রমাণ লাগবে।

সেক্ষেত্রে তাদের খরচে বা হিসাবরক্ষণে কোথায় ডাম্পিং হচ্ছে, সেখানে লাগবে স্বচ্ছতা। দুর্ভাগ্যবশত, অনেকের মাঝে এই স্বচ্ছতাটা নেই। এটার একটা কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে এই হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়াটা সঠিকভাবে করা হয় না। হয়তো তারা ডাম্পিং করছে না। কিন্তু যেহেতু তাদের হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়াটা ভালোভাবে করা হয় না, তাই তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্যায় বা ট্যারিফের শিকার হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটা শিক্ষা। সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের অ্যান্টি ডাম্পিং বিভিন্ন ধরনের নন-ট্যারিফ পদক্ষেপ বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হবে। এগুলো মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশের ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, মিনিস্ট্রি অব কমার্স, বেসরকারি খাতের যেসব অ্যাসোসিয়েশন আছে এবং উৎপাদকদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।

অনেকে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালো করে জানেনও না।  অনেক সময় আলংকারিক উপায়ে অথবা পপুলারভাবে আমরা বলি, এগুলো অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কথার পক্ষে কিন্তু আমাদের যথেষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে। সে জায়গায় আমরা দুর্বল। আমাদের কাছে মনে হয়, শুধু প্রতিবাদ করার জন্য প্রতিবাদ করাটা যথেষ্ট নয়। যথার্থ তথ্যপ্রমাণ নিয়ে প্রতিবাদ করতে হবে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশনের গবেষণার কাজ করার কথা। এছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে যারা নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে বিভিন্ন কর্মশালা করে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি নেগোসিয়েশন স্কিলও বাড়াতে হবে। কোনো কোনো জায়গায় অবশ্যই হয়তো আমাদের অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেটাকে তো নেগোসিয়েট করতে হবে। নেগোসিয়েশনের কতগুলো লেভেল আছে। যেসব জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, সেসব জায়গায় শক্ত জবাব দেওয়ার সুযোগ থাকলে উচ্চপর্যায়ে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমাদের যেটা হচ্ছে আমরা যখন শক্তভাবে জবাব দিতে পারি না, তখন অন্যভাবে সমাধান করার চেষ্টা করি।

আমরা কি প্রতিটি দেশের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার চেষ্টা করব? সবকিছু প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বলে দেবেন?  আমাদের যেটা করতে হবে, ট্যারিফ বা নন-ট্যারিফ রিলেটেড যে সমস্যাগুলো হচ্ছে, সেসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আমরা যদি সঠিকভাবে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে না পারি, তাহলে এটি দীর্ঘায়িত হতে থাকবে। বিএসটিএর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিএসটিএর সক্ষমতা বাড়ানোর পর যদি দেখি এটির পণ্য ভারতের চেয়ে অগ্রগতি হয়েছে, যেমন- সিঙ্গাপুর নিচ্ছে ভারত নিচ্ছে না- এমন অবস্থা তৈরি হলে ভালোভাবে বলার সুযোগ থাকবে। আমরা বলতে পারব আমাদের পণ্য অন্যান্য দেশ নিচ্ছে। তোমরা কেন নিচ্ছ না? তাহলে কি তোমরা অন্যায়ভাবে আমাদের পণ্য নিচ্ছ না! এ কথা বলার পূর্বশর্ত হলো আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের অনেক বিনিয়োগকারী আছেন, যারা ভারতে বিনিয়োগ করতে চান। যদিও তারা দেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। ভারতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দোষের কিছু দেখি না। যেহেতু আমাদের দেশে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট রাখতে একটা ভীতি আছে। তাছাড়া টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে। আবার আমাদের রেগুলেটর অথরিটি বা বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, যদি পুরোপুরি অনুমতি দেওয়া হয় বাইরে বিনিয়োগ করার, তাহলে হয়তো বেশ বড় পরিমাণে টাকা বাইরে ঠেলে দেওয়া হবে।

তারা হয়তো অ্যাপ্রোচটা নিয়েছে কেস বাই কেসেস। আমরা মনে করি কেস বাই কেসেস বেসিসে কিছুদিন বাংলাদেশের বাইরে বিনিয়োগ করার বিষয়টিকে বিবেচনা করা যেতে পারে। হয়তো কোটেশনটা বাড়ানোর সুযোগ আছে। যে বিনিয়োগটা বাংলাদেশ থেকে ভারতে হচ্ছে, সেটা যদি আরও কিছু বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ থেকে ভারতে করতে চায়, তাহলে শর্তটা হচ্ছে, কি পরিমাণে অর্থ তারা বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনছে এবং লাভটা বাংলাদেশের কি হচ্ছে- সে জায়গায় হয়তো প্রতিষ্ঠানগুলোর দেন-দরবার করার সুযোগ আছে।

আমরা মনে করি যে, ভারতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বালাদেশের বিনিয়োগকারীরা বেশি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ভারতে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নিয়ম-নীতি হচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরে অবস্থিত রাজ্যগুলোতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ভারত নতুন নতুন নিয়মনীতি চালু করেছে। যদিও ওই অঞ্চলগুলোতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। অনেক ক্ষেত্রে মনে করি বাংলাদেশের জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাওয়া উচিত। আমরা পণ্যের কথা বাদ দিই, পর্যটনের কথাও যদি বলি, বিশেষ করে পর্যটন খাতে বাংলাদেশ-ভারত একসঙ্গে বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের যে পর্যটনের জায়গাগুলো রয়েছে, সেটা কালচারভিত্তিক হতে পারে বা ধর্মীয় দিকসহ বিভিন্ন দিক হতে পারে। এছাড়াও শিক্ষা খাতে জয়েন্ট ভেঞ্চারের সুযোগ রয়েছে। সেবা খাতেও জয়েন্ট ভেঞ্চারের সুযোগ আছে।
ভারতের অর্থায়নে প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি শ্লথগতির বলে অভিযোগ রয়েছে। এখানেও কিছু সমস্যা আছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রজেক্টটা যথাযথভাবে ডিজাইন করতে না পারা, সময়মতো প্রপোজালটা ডেভেলপ করতে না পারা, যথাযথভাবে নেগোসিয়েট করতে না পারা। আমাদের তো ভারত থেকে অর্থ নিয়ে উন্নত করাই একমাত্র উদ্দেশ্য না। অন্যান্য দেশ থেকেও নেওয়ার সুযোগ আছে। সেগুলোও কিন্তু এক্সিকিউট করার সুযোগ রয়েছে। শুধু ভারত থেকে পাওয়ার জন্য নয়, অন্যান্য বিভিন্ন প্রকল্পেই দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয় যে, ভারতেরও আমলাতান্ত্রিক সমস্যাগুলো আছে। তাদের বেশকিছু মনমানসিকতাও বাধা হিসেবে কাজ করছে।

সমাধানের পথ হচ্ছে ট্রান্সপারেন্সি থাকা। অর্থাৎ কোনো ধরনের প্রজেক্টগুলো হচ্ছে, সে প্রজেক্টগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখাতে পারে, তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একটা স্বচ্ছতা থাকা উচিত। পাশাপাশি জবাবদিহির জায়গায় আসা উচিত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাগুলো দূর করা আবশ্যক। দু’পক্ষের দক্ষ লোকগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। যারা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ রয়েছেন, তারা যদি এ কাজে অংশগ্রহণ করেন, তারা যাতে সুন্দর মতামত দিতে পারেন সে সুযোগটা থাকা দরকার।

অনেক সময় আমরা দেখি যে, বিভিন্ন প্রজেক্ট হয়, সেগুলোতে ডিজাইনে বড় ধরনের সমস্যা হয়, যা আমরা পরে উপলব্ধি করি। অনেক সময় প্রথম থেকে অভিজ্ঞ লোকজনের ইনভলভমেন্ট থাকে না। এ জায়গাগুলোতে নজর দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি জোর দেব, ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য যে ইকোনমিকস হোমগুলো প্রস্তাবিত আছে, এগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা।
বিবিআইএন মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্ট থেকে ভুটান বের হয়ে গেছে। নেপালেরও কিছু সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয়ভাবে এটা শুরু করতে পারে। এটা অনেক ক্ষেত্রেই খরচ কমিয়ে দেবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানিকারকদের জন্য। সেটা করার জন্য যে পূর্বশর্তগুলো আছে, অবকাঠামো উন্নয়নের যে জায়গাগুলো, এসব অবকাঠামো উন্নয়নের জায়গাগুলোতে ভারত কিন্তু বিনিয়োগ করতে পারে। লাভ কার বেশি হবে সেটি চিন্তা করলে দেখা যাবে বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের সুযোগ বেশি। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলাবন্দর আছে।

সেগুলোর মাধ্যমে যদি আমরা ইন্টিগ্রেটেড আঞ্চলিকভাবে গড়ে তুলতে পারি, সেটাতে কিন্তু বাংলাদেশও সুবিধা পাবে। সেটা কিন্তু নেপাল ও ভুটানকেও দিতে পারবে। ভারতের অন্য যে রাজ্যগুলো আছে তারা তো বটেই বিদ্যমান যে পরিকল্পনাগুলো আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা এবং তার জন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া সেটাকে আরও ত্বরান্বিত করা দরকার।
বাংলাদেশের যে অতীতের অগ্রগতি তার ওপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের উদ্যম নিয়ে সামনে এগোতে হবে। এটা ভাবার কারণ নেই যে, বিগত দিনগুলোতে গতানুগতিক যেভাবে আমরা এগিয়েছি, সামনের দিনগুলোতে সেভাবে এগোব। কারণ, বাংলাদেশের সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন- আগামী ১০ বছরের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ২০ বছরের মধ্যে ধনী দেশে পৌঁছানো।

সে জায়গায় পৌঁছাতে বাংলাদেশের বড় ধরনের অ্যাটিচিউড উন্নতি দরকার। এর অর্থ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সব চুক্তি রয়েছে, সেগুলোতে বাংলাদেশকে আরও প্রোঅ্যাকটিভ হতে হবে। বাংলাদেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এলএসির মাধ্যমে তার বাণিজ্য সুবিধা হারাবে ২০২৬-এর পর থেকে। ভারতের সঙ্গে যে দ্বিপক্ষীয় চলমান চুক্তি আছে, সেটিকে কিভাবে আরও কার্যকর জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। পাশাপাশি, শুধু ভারত-বাংলাদেশ না, বৃহত্তর পরিসরের কথা বলছি, আঞ্চলিক জায়গাগুলোতে আরও প্রোঅ্যাকটিভ হওয়া। আমাদের যারা নীতিনির্ধারক রয়েছেন, যারা বাণিজ্য বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোতে যুক্ত, তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, তাদের মনমানসিকতাকে আরও বেশি ডায়নামিক করা।

আমরা বলব, নতুন নতুন যে উন্নয়নগুলো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বা আঞ্চলিকভাবে, বাণিজ্য আলোচনার ক্ষেত্র বা চুক্তির বিষয়েও আপডেট থাকতে হবে। নতুন অ্যাপ্রোচ নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলে মনে হয় যে, সামনের দিনগুলোতে যে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে, সেগুলো মোকাবিলা করতে পারব। পুরনো পদ্ধতিতে এগোলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালকÑবাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

×