ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার

ড. অরূপরতন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২৮ মার্চ ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার

ড. অরূপরতন চৌধুরী

এই বেতার কেন্দ্রে তখন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথার্থ না থাকলেও প্রত্যেকের ছিল উদ্যমতা। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটির দোতলার ছোট কক্ষটিতে (যেখানে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন) দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার, সীমিতসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র, কতিপয় যন্ত্রশিল্পী, চাদর টাঙ্গানো রেকর্ডিং রুমেই চলে রেকর্ডিং কাজ

৯ মাস সম্মুখ মুক্তিযুদ্ধে দেশের অজস্র বীর সন্তান জীবন দান করেছেন অকাতরে। অবিস্মরণীয় তাদের এ অবদান। দেশমাতৃকার স্বাধীনতায় জীবনকে তুচ্ছ ভেবে শত্রুর মোকাবিলায় তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। এমনও কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা অস্ত্র হাতে তুলে নেননি, কিন্তু তাদের কণ্ঠÑ তাদের আওয়াজ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মুক্তি সেনানীদের, আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় জনগণকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে ভূমিকা রেখেছেন। দেশকে স্বাধীন বাংলাদেশ অবদান রেখেছেন। তারা হলো স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলার পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সাহস যুগিয়েছে; যুগিয়েছে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা এবং হানাদার বাহিনীকে সর্বক্ষণ রেখেছে ভীতসন্ত্রস্ত তা হলো ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’। আর এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ৬টি বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম প্রচ-ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়া হয়েছে একমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল শক্তিশালী একটি প্ল্যাটফর্ম। প্রয়াত কামাল লোহানী বলেছেনÑ ‘আমাদের জন্য বেতার ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধক্ষেত্র, যার মাধ্যমে আমরা জনগণের সাহস বাড়াতে সহায়তা করেছিলাম।’
এই বেতার কেন্দ্রে তখন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথার্থ না থাকলেও প্রত্যেকের ছিল উদ্যমতা। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটির দোতলার ছোট কক্ষটিতে (যেখানে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন) দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার, সীমিতসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র, কতিপয় যন্ত্রশিল্পী, চাদর টাঙ্গানো রেকর্ডিং রুমেই চলে রেকর্ডিং কাজ। দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে প্রায় ৭০জন রাত যাপন করতাম। এই বেতার কেন্দ্রই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।
প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল চট্টগাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মী (দুজন বেতার কর্মী ছিলেন না), স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনগণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতায়। এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ১০ জন সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল মোহাম্মদ (উক্ত বেতারের তৎকালীন নিজস্ব শিল্পী), আবদুল কাশেম সন্দ্বিপ (ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আবদুল শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন বেতার প্রকৌশলী), আব্দুল্লাহ আল ফারুক (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুর হোসেন (তৎকালীন টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), আমিনুর রহমান (তৎকালীন টেকনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট), শারফজ্জামান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিবউদ্দিন (তিনি বেতার কর্মী ছিলেন না)। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পর প্রবাসী সরকার কাজ শুরু করে। ১৯ এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আবদুল মান্নানকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২৪ মে দুটি রেকর্ডার মেশিন এবং মাত্র ১টি মাইক্রোফোন দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার ২৫ মাইল দূরে ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে কোরআন তেলাওয়াত ও বক্তৃতার মাত্র ১০ মিনিটের প্রচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতারের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে।

মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে সেকেন্ড প্রতি ৮৩০ কিলোসাইকেলে প্রতিধ্বনিত হয় এটি। শুরুতে কেন্দ্রটিকে বেশ সমস্যার দিয়ে যেতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অত্যধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘চরমপত্র’। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ, রণাঙ্গনের সাফল্য কাহিনী, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসরসহ আরও কিছু অনুষ্ঠান পরিধি বাড়তে বাড়তে দৈনিক ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত নিয়মিত প্রচার হতো। এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠ সৈনিক ছিলাম আমিও, যার জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করি।
ইথারে ভেসে আসা শব্দ যে বুলেটের চেয়েও শক্তি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে টিক্কা-নিয়াজী- ফরমান আলীর পাক-পশুরা সেদিন বুলেট-বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে নরপশুদের বিরুদ্ধে। মুজিবনগর সরকার নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে।

প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৭১ সালের ২৫ মে মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যক্রম শুরু করে, যা ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অবদানের কথা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি এই বেতার কেন্দ্রের সকল শিল্পী কলা-কুশলীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি ও যুদ্ধে তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয় ও সকল পর্যায়ে সমাদৃত। বর্তমান সরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকল শব্দসৈনিককে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা ও স্বীকৃতিই দিয়েছেন, তাদের জন্য ভাতাও বরাদ্দ করেছেন। 

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

×