ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-ভারত উন্নয়ন সম্পর্ক

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ২৩ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশ-ভারত উন্নয়ন সম্পর্ক

বাংলাদেশ-ভারতের যে সম্পর্ক সেটি রক্তের অক্ষরে লেখা

বাংলাদেশ-ভারতের যে সম্পর্ক সেটি রক্তের অক্ষরে লেখা। ভারতের সরকার এবং তাদের জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সহায়তা এবং সাহসী ভূমিকা রেখেছে, বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন রক্তের অক্ষরে লেখা থাকবে সেটি। তাদের সঙ্গে এদেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় সেই সম্পর্কের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের সম্পর্ক তুলনীয় নয়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আবেগ ও আদর্শিক অবস্থানের উপস্থিতি লক্ষণীয়। ভারত মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন সত্তাকে স্বীকার করে নিতে দেরি করেনি। বিনিময়ে বাংলাদেশও তার প্রতিদান দিতে কার্পণ্য দেখায়নি।

ভারতের সঙ্গে রয়েছে আমাদের ইতিহাসের, ভাষার, সংস্কৃতির, মনমানসিকতার গভীর সমন্বয়। রয়েছে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার সমৃদ্ধ ইতিহাস। ‘ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ডিজেল পাইপলাইন’ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আরেকটি মাইলফলক রচিত হয়েছে। সত্যিকারের প্রকৌশল বিস্ময় প্রকল্পটি হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি তেলের মৈত্রী পাইপলাইন। অসম রাজ্যের নুমানিগড় রিফাইনারি থেকে শিলিগুড়ি টার্মিনালের সীমান্ত অতিক্রম করে পাবর্তীপুর ডিপোতে এই মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আনার কার্যক্রম গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বোতাম টিপে উদ্বোধন করেন।

১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ডিজেল রপ্তানি করবে ভারত। এতদিন ভারত থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা হতো রেলের ওয়াগনের মাধ্যমে। প্রকল্পটি উদ্বোধন হওয়ায় কৃষিনির্ভর উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় নিরবচ্ছিন্ন ডিজেল সরবরাহ সম্ভব হবে।
২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর পাইপলাইনে তেল আমদানি করতে ভারতের কাছ থেকে প্রস্তাব পায় বাংলাদেশ। বর্তমানে ক্রুড ও পরিশোধিত তেল সামুদ্রিক জাহাজ, নৌজাহাজ, ওয়াগন ট্রেন এবং ট্যাংক লরিতে পরিবহন করা হচ্ছে। দীর্ঘকাল ধরে এ চার উপায়ে বিদেশ থেকে আমদানি থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু এতে সিস্টেম ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়তে থাকার যুক্তি এনে তেল পরিবহনে পাইপলাইন ব্যবহারের পরিকল্পনা করে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন’ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।

ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) থেকে নেওয়া প্রায় ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ভারতীয় রুপি ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ১৩১ দশমিক ৫ কিলোমিটার  মৈত্রী পাইপলাইন। প্রকল্পটি সত্যিকারের এক প্রকৌশল বিস্ময়। এটি বাস্তবায়নে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে ঠিকই, তবে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত বোঝাপড়ার কল্যাণে আন্তর্জাতিক প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেছে। অসম্ভব কাজটি সম্ভব হয়েছে  বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের নিবিড় বন্ধুত্বের কারণে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশের সেরা সম্পর্কের প্রমাণ হয়ে থাকবে।

প্রকল্পটি ভারতের শিলিগুড়ির নুমানিগড় রিফাইনারি থেকে বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে পঞ্চগড়, নীলফামারী,  দিনাজপুর হয়ে পার্বতীপুর ডিপোতে সংযুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে পড়েছে ১২৬ দশমিক ৫৭ কি.মি. এবং ভারতের অংশে ৫ কি.মি.। পাইপলাইনটির হাইস্পিড ডিজেলের (এইচএসডি) বার্ষিক পরিবহনের ক্ষমতা এক মিলিয়ন মেট্রিক টন (এমএমটিপিএ)।
পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে ডিজেল আমদানিতে ব্যয় ও সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল আনতে প্রতি ব্যারেলের প্রিমিয়াম প্রাইস পড়ে ১১ ডলার। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে খরচ পড়বে ৫ দশমিক ৫০ ডলার। অর্থাৎ প্রায় ৬ ডলারের মতো প্রিমিয়াম সাশ্রয় হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে  বড় বড় ট্যাংকার জাহাজে তেল চট্টগ্রাম বহির্নোঙরে আসে। সেখান থেকে ছোট ছোট জাহাজে আসে খুলনার দৌলতপুরে। তারপর ব্রডগেজ লাইনে আনা হয় পার্বতীপুর ডিপোতে।

রেলপথে চট্টগ্রাম থেকে তেল আনতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়, অনেক সময় অপচয়ও ঘটে। সরাসরি আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইন দিয়ে এসব ঝামেলা ছাড়াই তেল আনা যাবে।
ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ভাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবাধ প্রবাহ, ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সেতুবন্ধন এই দুদেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর করেছে। এই বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করতে উভয় দেশই একে অপরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে উপআঞ্চলিক পর্যায়সহ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আরও কয়েকটি উদ্যোগ বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। চালু হয়েছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে সমস্যা ছিল সেটাও সমাধান করা হয়েছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দুদেশের কল্যাণে বর্তমান সরকার একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মোংলা বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং  সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসেবে ভারতের জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এই বন্দরগুলো ভারতের ব্যবহার করতে কোনো অসুবিধা হবে না। যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হবে। দুদেশের মানুষ হবে লাভবান।
বিগত বছরগুলোতে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপদান করা হয়েছে। দুদেশের মধ্যে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোরও সমাধান করা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তি করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে যেসব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলÑ রেল যোগাযোগ থেকে শুরু করে সড়ক যোগাযোগÑ সবই বর্তমানে উন্মুক্ত হয়েছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসারণ ঘটেছে।  বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আমরা ভারতের কাছ থেকে প্রভূত সহযোগিতা পাচ্ছি। সেইসঙ্গে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা জোরদার করা, উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়েও কাজ হচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে অবদান তা কখনো ভোলার নয়।  মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার এবং জনগণ বাংলাদেশকে অকুণ্ঠ  সমর্থন জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে স্থান দেওয়া, খাবারের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র দেওয়াÑএসব সহযোগিতা ভারতের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর অভিযানে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি।
গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করেছে। খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি নতুন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন হয়েছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বিশ্বের সব উন্নত দেশের সঙ্গে উড়বে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা।


লেখক : অধ্যাপক, ট্রেজারার
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×