
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ আলোচিত হয়ে আসছে
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ আলোচিত হয়ে আসছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির পর থেকেই নানা মহলে সমালোচনা ছিল তুঙ্গে। বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহারের জন্য ২০১৬ সালে নামমাত্র মাসুল ধার্য করার পর তা সমালোচনার আগুনে ঘিয়ের মতো কাজ করে। এরপর জল গড়িয়েছে অনেক দূর।
২০১৮ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরে এক চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়া হয়। তবে এসবের মধ্যে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের করিডর ব্যবহারের জন্য দীর্ঘদিনের দরকষাকষির পরও ভারতের কোনো সদিচ্ছা দেখা যায়নি।
সর্বশেষ, গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক-পরবর্তী যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের সম্পর্কের বিভিন্ন দিকের পাশাপাশি চলমান সহযোগিতা, অমীমাংসিত বিষয়, ভবিষ্যৎ সহযোগিতা ও সংযুক্তির বিষয়গুলো উঠে এসেছে। যৌথ বিবৃতি থেকে জানা যায়, ভারতের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে বিনা মাসুলে ট্রানজিট দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত।
এ প্রস্তাব কার্যকর হলে ভারতের স্থলপথ ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। ভারতের ট্রানজিট বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ট্রাকগুলো নেপাল ও ভুটানের সীমান্তে পণ্য রপ্তানি ও আমদানি করার সুযোগ পাবে। স্থলপথ ছাড়াও পণ্য পরিবহনে ভারতের বিমানবন্দরও ব্যবহার করতে পারবে বাংলাদেশ।
ট্রানজিটের ইতিহাস
ভারত দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশের নৌরুট ও সড়কপথে ট্রানজিট পেয়ে আসছে। স্বাধীনতার আগে ভারত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে নৌ-ট্রানজিট পেত। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো ‘অভ্যন্তরীণ নৌ-ট্রানজিট ও বাণিজ্য’ প্রটোকল স্বাক্ষর হয়। এর আওতায় ভারতীয় নৌযানগুলো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ও বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে পারে।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৩টি রাজ্যে নিয়মিত পণ্য পরিবহনে বহুমুখী ট্রানজিট ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে দুদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম একটি চুক্তি হয়।
ওই চুক্তিতে একইসঙ্গে নদী ও সড়কপথে বহুমুখী ট্রানজিটের মাধ্যমে ব্যবহার করে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদকে অসম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কথা বলা হয়। ভারতের নিজ ভূখ- ব্যবহার করে কলকাতা থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের নৌপথ ও স্থলপথ ব্যবহার করে মাত্র ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আগরতলায় পণ্য পৌঁছানো যায়। এ রুটে পণ্য পরিবহনের জন্য টনপ্রতি মাসুল নির্ধারিত হয় ১৯২ টাকা। এছাড়াও নিরাপত্তা ও নৌবন্দর শিপিং মাসুলসহ প্রতি টন পণ্যে বাংলাদেশের আয় ২৭৭ টাকা।
পরবর্তীতে, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও তৃতীয় দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের রূপরেখা বিষয়ে এসওপি সই হয়। পরীক্ষামূলক চারটি চালানের জন্য স্ক্যানিং, নিরাপত্তা, ডকুমেন্ট প্রসেসিং মাসুল ও বিবিধ প্রশাসনিক চার্জসহ টনপ্রতি সর্বমোট মাসুল নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫৪ টাকা।
সর্বশেষ, এ বছর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে ভারত পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত একটি ট্রানজিট রুট চেয়েছে। এ রুটে পণ্য পরিবহনের জন্য অন্তত ১০ কিলোমিটার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। একই বৈঠকে সদ্য উদ্বোধন হওয়া চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটের মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ চেয়েছে বাংলাদেশ।
ট্রানজিট রুট ও চালান
২০১৬ সালের জুন থেকে ভারতকে বিদ্যমান নৌ-প্রটোকলের আওতায় প্রথমে কলকাতা-আশুগঞ্জ নৌপথ এবং তারপর আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কপথ ব্যবহার করে ত্রিপুরার আগরতলায় পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ। ২০২০ সাল পর্যন্ত এ রুটে মাত্র ১৭টি চালান নেয়ার পর দীর্ঘদিন যাবৎ এ রুটে পণ্য পরিবহন স্থবির হয়ে আছে।
২০১৯ সালে চট্টগ্রাম/মোংলা বন্দর থেকে আখাউড়া, তামাবিল, শ্যাওলা ও বিবিরবাজার স্থলবন্দর দিয়ে ৪টি রুটে পরীক্ষামূলক চালান নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। ২০২০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ভারতের প্রথম পরীক্ষামূলক ট্রানজিট ও একটি ট্রান্সশিপমেন্ট চালান আসে। এ বছর আগস্ট মাসের শুরুতে কলকাতা থেকে পণ্যবাহী দুটি কন্টেনার মোংলা বন্দরে খালাস করে সড়কপথে একটি মেঘালয়ে এবং অন্যটি অসমে নেয়া হয়।
করোনা মহামারীর ফলে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর চলতি মাসে কলকাতা থেকে ভারতের একটি চালান চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। চট্টগ্রাম থেকে খালাস করে সড়কপথে পণ্যগুলো শ্যাওলা-সুতরাকান্দি স্থালবন্দরের মাধ্যমে অসমে নেয়া হয়।
এছাড়াও, বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি ট্রানজিট সুবিধা পেয়েছে ভারত। সম্প্রতি অসমের বন্যায় রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ত্রিপুরা, অসম ও মিজোরামে পেট্রোলিয়াম পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে।
ফলে ভারতের তেলের ট্যাংকারগুলো তামাবিল দিয়ে প্রবেশ করে চাতলাপুর স্থলবন্দর পর্যন্ত বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহার করে এসব রাজ্যে পেট্রোলিয়াম পরিবহন করছে। চুক্তির আওতায় এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এ রুট খোলা থাকবে। একইভাবে ২০২১ সালে নেপালে ৫২ হাজার টন সার রপ্তানিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহানপুর-সিঙ্গাবাদ এবং দিনাজপুরের বিরল-রাধিকাপুর হয়ে দুটি রেলপথে বাংলাদেশকে ট্রানজিট দিয়েছে ভারত।
ট্রানজিটে কার লাভ
বাংলাদেশ ও ভারতের ট্রানজিট চুক্তি দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি ও পণ্য পরিবহনকে সহজ এবং সাশ্রয়ী করে তুলবে। ট্রানজিটের চালান থেকে সরকারি মাসুলের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি খাতে আয় করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। সরকারি খাতে পণ্য পরিবহন মাসুল ও বন্দরের সেবা মাসুল এবং বেসরকারি পরিবহন খাত থেকে আয় করবে বাংলাদেশ।
চার বছরে কলকাতা-আশুগঞ্জ নৌ-রুটের ১৭টি চালান থেকে মাসুলবাবদ সরকার পেয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। গত মাসে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে কলকাতা থেকে অসমে যাওয়া পণ্যের চালান থেকে সরকারি ও বেসরকারি খাতে সর্বমোট আয় হয়েছে ২ লাখের বেশি।
নৌপথে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও জাহাজগুলো সম্পৃক্ত থাকায় এ খাতেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে বাংলাদেশ। কলকাতা থেকে আশুগঞ্জের বৃহৎ চালানগুলো পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত ছিল বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান আনবিস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে দুই চালানের পণ্য পরিবহন করেছে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি ট্রান্স সামুদেরা।
কলকাতা থেকে মোংলা বন্দরে ভারতীয় পণ্যের একমাত্র চালানটি পৌঁছে দেয় বাংলাদেশী জাহাজ এমভি রিশাদ রায়হান। সমুদ্র ও নদী বন্দর থেকে পণ্যগুলো সড়কপথে ভারতের সীমান্তে পৌঁছতে বাংলাদেশী ট্রাক ব্যবহার করা হবে। ফলে ট্রানজিটের মাধ্যমে বেসরকারি পরিবহন ও সেবা খাত থেকে আয়ের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
করণীয়
আয়ের পাশাপাশি বাড়তি পণ্যের চাপ থাকায় অবকাঠামো ও জনবলের পেছনে অতিরিক্ত অর্থ খরচ হবে বাংলাদেশের। পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকায় কলকাতা-আশুগঞ্জ-আখাউড়া রুটে খরচ কম হওয়া সত্ত্বেও পণ্য পরিবহনে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ট্রানজিট চালুর পর থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪ বছরে কলকাতা-আখাউড়া রুট ব্যবহার করে মাত্র ১৭টি চালানে পণ্য পরিবহন করা হয়েছে।
কম মাসুলে ট্রানজিটের চুক্তি করায় সে সময় বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। বাস্তবে গত আড়াই বছর যাবৎ এ রুটে কোনো ট্রানজিটই নেয়নি ভারত। আশুগঞ্জ বন্দরটি আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ায় এবং উন্নত কন্টেনার ডিপো, গুদামঘর, পর্যাপ্ত জনবল প্রভৃতি সুবিধা না থাকায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এ বন্দর ব্যবহারের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ফলে বন্দরের রক্ষণাবেক্ষণে অর্থ খরচ করা হলেও ব্যবহার না থাকায় সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে কলকাতার ত্রিপুরার সরাসরি রেল সংযোগ স্থাপনের জন্য আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ট্রানজিট মাসুল থেকে এসব অবকাঠামোর ব্যয় তুলতে পারবে কিনা তা যাচাই করেই এসব অবকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। তবে অবকাঠামোগত উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ট্রানজিট ফি পুনর্নির্ধারণ করতে হবে অবশ্যই।
ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির সুবিধা পেতে হলে বন্দর অবকাঠামো উন্নয়ন, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, সড়ক যোগাযোগ সহজ করা এবং কাস্টমস ও শুল্ক আদায়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। তাতে একইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হবে।
পাশাপাশি ভারতের করিডর ব্যবহারের সুযোগ পেলে নেপাল ও ভুটান কলকাতার পরিবর্তে বাংলাদেশের মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করলে তাদের পরিবহন খরচ এবং ট্রানজিট মাসুলও কমবে। উভয় পক্ষই লাভবান হওয়ায় বাংলাদেশী পণ্য আমদানিতে নেপাল ও ভুটানের আগ্রহ বাড়বে। সেইসঙ্গে পরিবহন সহজ হওয়ায় দেশ দুটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে ভারতের সঙ্গে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি, বিবিআইএন প্রভৃতি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংযুক্তি বাড়বে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে।
লেখক : গবেষক