
পিআর নির্বাচন: কতটা সম্ভাবনাময় এই পদ্ধতি, কোন পথে হাঁটবে বাংলাদেশ?
সামনে জাতীয় ভোটের ঘণ্টা বাজছে, আর ঠিক তখনই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি। পিআর নিয়ে কেউ উৎসাহী, কেউ শঙ্কিত, কেউবা দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তু রাস্তাঘাট থেকে সোশ্যাল মিডিয়া- সবখানে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: আদর্শের পথে হেঁটে কি সত্যিই বদলাবে বাংলাদেশের রাজনীতি, নাকি আবারও পুরনো কৌশলের ফাঁদেই বন্দি থাকবে ভোটের ভাগ্য?
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (Proportional Representation) অনেকের কাছে এখনো অজানা বা দুর্বোধ্য শোনালেও, বাস্তবে এটি হতে পারে আমাদের রাজনীতির গভীর রোগের একটি কার্যকর ওষুধ।
জনগণের ভোট যেন আর হারিয়ে না যায়, ভোটের ভিত্তিতে প্রতিটি কণ্ঠস্বর সংসদে প্রতিফলিত হোক -এই দাবি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
গত ২৮ জুন ২০২৫ রোজ শনিবার। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেন পরিণত হয়েছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতির এক নতুন মোড় ঘোরানো মঞ্চে। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের ডাকে আয়োজিত বিশাল মহাসমাবেশে জমায়েত হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। জনসমুদ্রের মতো বিশাল এই সমাবেশ শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্যই নয়, বরং এক ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক দাবির কারণে জাতীয় পরিসরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
এই সমাবেশে একটি প্রশ্নই ঘুরেফিরে এসেছে— বাংলাদেশ কি সংখ্যানুপাতিক (Proportional Representation) পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত? কিংবা আরও গভীরভাবে বলা যায়, দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, মনোপলি রাজনীতি ও পেশীশক্তি নির্ভর ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে পিআর পদ্ধতি কি হতে পারে একটি কার্যকর সমাধান?
সমাবেশের পটভূমি: একক দল নয়, একক বার্তা
সমাবেশটি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত হলেও সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলাম, এনসিপি, খেলাফত আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, হিন্দু মহাজোট, বৌদ্ধ সংগঠন ‘বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্র’, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনসমূহ। দলগুলোর ভিন্ন আদর্শ, ভিন্ন দর্শন, ভিন্ন অবস্থান থাকা সত্ত্বেও তারা আজ একসুরে উচ্চারণ করেছে একটি দাবি— সংবিধানে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে হবে।
প্রসঙ্গত, বিশ্বের প্রায় ৮৫টিরও বেশি দেশে বর্তমানে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতি চালু রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ফিনল্যান্ড, ইসরায়েল, ইন্দোনেশিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্কের মতো দেশ।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি কী এবং কেন?
বর্তমানে বাংলাদেশে যে নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলিত, তা ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ (FPTP)। এই পদ্ধতিতে একটি আসনে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন। এতে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে কেউ জিতে যেতে পারেন, যদি বাকিদের ভোট ছড়িয়ে যায়।
ধরা যাক, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছে। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেল। আর চতুর্থ প্রার্থী পেলো ২৫ শতাংশ ভোট।
বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট তেমন কোন কাজে আসছে না।
একই ভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবে। অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকলো না সংসদে। এতে সংসদে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকে না।
অন্যদিকে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সংসদের মোট আসন দলীয় মোট ভোটের অনুপাতে ভাগ হয়। যেমন— যদি কোনো দল জাতীয়ভাবে ১০% ভোট পায়, তাহলে সে ৩০টি আসন পাবে। এতে করে ভোটের অপচয় রোধ হয়, এবং প্রতিটি ভোটারের মতামত সংসদে প্রতিফলিত হয়।
বাংলাদেশের বাস্তবতা: আদর্শ বনাম অভ্যাস
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে পেশীশক্তি, টাকার দাপট, নমিনেশন বাণিজ্য, দলীয়করণ এবং বেকার তরুণদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় রাখার একটি চক্রাকারে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি যদি চালু হয়, তাহলে-
১. ভোটের প্রকৃত মূল্যায়ন ও অপচয় রোধ:
বর্তমান ব্যবস্থায় (FPTP) যিনি বিজয়ী হন, তিনিই সবকিছু নিয়ে যান। ৪৯% ভোটার যিনি হারেন তাকে ভোট দিলেও সেটি কোনো কাজে লাগে না।
পিআর পদ্ধতিতে যে দল ৫% ভোট পাবে, সে সংসদে ৫% আসন পাবে। ফলে প্রতিটি ভোটের মূল্য বাড়বে এবং জনগণের ভোটদানের আগ্রহ বাড়বে।
২. সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ:
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ধর্মীয়, আদিবাসী, দলিত, নারী, হিজড়া, প্রতিবন্ধীদের প্রতিনিধিত্ব অনেকাংশে বেড়ে যাবে। ছোট দলগুলো যাদের নিজস্ব ভোট ব্যাংক আছে কিন্তু আসন পায় না -তাদেরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। ফলে বাংলাদেশ আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) গণতন্ত্রের পথে এগোবে।
৩. নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা ও প্রাণহানি কমে যাবে:
কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, সন্ত্রাস, ক্যাডারবাহিনী—এসবের প্রভাব কমে যাবে কারণ একটি কেন্দ্র জিতলেও কিছু আসে না, মোট ভোটের হিসাবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নির্বাচন হবে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, ও মানবিক।
৪. নমিনেশন বাণিজ্য ও টাকার দাপট কমবে:
একজন মাঠকর্মী দশ বছর ধরে কাজ করেও নমিনেশন পান না; বরং বিত্তশালী কেউ টাকার জোরে হঠাৎ প্রার্থী হয়ে যান -এই সংস্কৃতি বন্ধ হবে। পিআর পদ্ধতিতে কেন্দ্রভিত্তিক নমিনেশনের প্রয়োজন নেই, দল কেন্দ্রীয়ভাবে তালিকা দেয়। ফলে রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি দলগুলোর দায়িত্ববোধ বাড়বে এবং দলে ন্যায্য প্রতিদান প্রতিষ্ঠিত হবে।
৫. রাজনীতিতে আদর্শ ও পলিসির গুরুত্ব বাড়বে:
কে কয়জন লোক আনতে পারে, কে কত পোস্টার লাগিয়েছে, কে মাইক বাজিয়েছে -এগুলো গুরুত্ব হারাবে। বরং কে কী শিক্ষা নীতি প্রস্তাব করেছে। কে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কীভাবে উন্নত করতে চায়। কার বিদেশনীতি বা তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান পরিকল্পনা কী -এসব নিয়েই ভোট হবে। ফলে রাজনীতি হবে চিন্তাশীল, ভবিষ্যতমুখী এবং জনগণকেন্দ্রিক।
৬. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সহিংসতা কমে যাবে:
দলীয় নেতাদের আশীর্বাদ পেতে ছাত্ররা অস্ত্র তুলে নিচ্ছে, মিছিল-মিটিং করছে, হল দখল করছে-এই সংস্কৃতি ভেঙে পড়বে। কারণ আর কেউ আর ক্যাডার না বানিয়ে পলিসি ভিত্তিক দল করতে চাইবে। ফলে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরবে।
৭. রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার কমবে:
একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের কারণে বর্তমানে একদলীয় শাসনের মতো আচরণ চলে। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে জোট সরকার গঠনের প্রবণতা বাড়ে। এতে একক দল ‘জোর করে’ আইন পাস করতে পারে না। ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অনিয়ম অনেকাংশে রোধ হয়।
৮. বেকার-ভবঘুরেদের রাজনীতি করা কঠিন হবে:
বর্তমানে অনেক রাজনৈতিক কর্মীর মূল পরিচয় "দলের লোক", যাদের কাজ নেই, জীবন নেই, আদর্শও নেই।
পিআর পদ্ধতিতে দলের ভাবমূর্তি, নীতিমালা, পলিসি—এসবই নির্ধারক হওয়ায় এসব ‘চাঁদাবাজ-ভাড়া করা’ লোকের জায়গা কমবে। রাজনীতি হবে পেশাদার ও সুস্থ।
৯. গণমাধ্যম ও জনমত হবে বেশি কার্যকর:
ভোট পেতে হলে দলগুলোকে বিস্তারিত কর্মসূচি দিতে হবে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ট্রাফিক, নারীর অধিকার, গ্রামীণ উন্নয়ন, পররাষ্ট্রনীতি -সবকিছুতে। গণমাধ্যম ও টকশোগুলোতে পলিসি নিয়ে আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। ফলে জনগণও সচেতন হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে বুদ্ধিবৃত্তিক হবে।
১০. নির্বাচনকালীন সহিংসতা, টাকা ছড়ানো ও মাসল পাওয়ারের যুগ শেষ হবে:
পিআর পদ্ধতিতে কেন্দ্রে হানা দিয়ে কিছু হবে না—ভোটের শতকরা হারই আসল। ফলে রাজনীতিতে অস্ত্রধারীদের প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে।
১১. প্রবাসী, তরুণ ও প্রথমবারের ভোটাররা বেশি গুরুত্ব পাবে:
এরা দল দেখে না, দেখে কে কী বলছে। পিআর পদ্ধতিতে দলগুলো বাধ্য হবে তরুণ, শিক্ষিত, নতুন ভোটারদের কথা ভাবতে। ফলে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী রাজনীতি গড়ে উঠবে।
১২. সরকার গঠনে জবাবদিহিতা বাড়বে:
একক দল ক্ষমতায় না থেকে জোট সরকার গঠিত হলে, একাধিক দলের অংশগ্রহণ ও সমঝোতার প্রয়োজন হয়। ফলে আইন পাশ, বাজেট গঠনসহ সব কিছুতে জবাবদিহিতা বাড়ে।
সমালোচনাও আছে: সরকার কি দুর্বল হবে?
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে—এতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হয়, ফলে জোট সরকার গঠন করতে হয়। আর এই জোট যদি স্থিতিশীল না হয়, তাহলে দ্রুত সরকার পতন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, উন্নয়ন ব্যাহত ইত্যাদি সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের যে সংস্কৃতি রয়েছে, তাতে জোট সরকার কার্যকর হতে গেলে প্রয়োজন হবে জবাবদিহিতামূলক ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক রাজনীতির সংস্কার।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়: কে এগিয়ে আসবে?
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে হলে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে বড় দুই দলের সম্মতি ছাড়া এই পদ্ধতির বাস্তবায়ন অসম্ভব।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় একটি অদ্ভুত প্রবণতা বহুদিন ধরেই বিদ্যমান—ধর্মভিত্তিক দল বা আলেমসমাজ কোনো রাজনৈতিক দাবি তুললেই সেটিকে অবজ্ঞা করা হয়, কখনো সরাসরি বিদ্রুপ, কখনো ঘৃণামিশ্রিত চুপচাপ এড়িয়ে যাওয়া হয়।
এই অবস্থান একদিকে যেমন বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে, তেমনি গণতন্ত্রের মূল দর্শনের বিরোধী। কারণ গণতন্ত্রে দাবির উৎস নয়, দাবির যুক্তিসংগততা ও প্রাসঙ্গিকতাই হওয়া উচিত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের রাজনীতি যদি একটানা বাঁচে ধ্বংস আর দখলের ছকে—তবে সেখান থেকে মুক্তির জন্য একটিই রাস্তা খোলা থাকা উচিত: নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন এটি কেবল একটি ভোট গণনার হিসাব নয়; বরং এটি গণতন্ত্রে সত্যিকার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার এক নতুন আশা। এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে ব্যালটের বাক্স ছিনতাই করে কেউ জিততে পারে না। যেখানে দলীয় মনোনয়ন পেতে কোটি টাকা খরচ করে কেন্দ্র দখলের দিন শেষ হয়। যেখানে পেশীশক্তি নয়, আদর্শ-রাজনীতির মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।
সতর্ক দৃষ্টি এখন রাজনৈতিক মহলের দিকে - পিআর পদ্ধতির পক্ষে এই জোয়ার কি কেবল মঞ্চেই গর্জে উঠবে না কি সত্যিই কোনোদিন বয়ে আনবে একটি নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা?
তাসমিম