ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুদ্ধ নয় শান্তি চাই

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

যুদ্ধ নয় শান্তি চাই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সবচেয়ে সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে পড়েছে বিশ্ব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বে মোড়ল হিসেবে খ্যাত দেশগুলো এই যুদ্ধ বন্ধে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে তো পারছেই না, উল্টো নতুন করে চীন-তাইওয়ানের দ্বন্দ্বের আগুনে ঘি ঢালার বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। জাতিসংঘের ভূমিকা অনেকটা ‘রোম পুড়ে যাচ্ছে, নিরো বাঁশি বাজাচ্ছে’ এর মতো।

এমন কলহময় পৃথিবীতে শান্তির বার্তা শোনালেন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তার ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ এই দৃপ্ত উচ্চারণ তাকে ইতোমধ্যে পৃথিবীর মধ্যে শান্তির দূত পরিগণিত করেছে। তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ থেকে শান্তির পক্ষে এমন সাহসী উচ্চারণ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন যুদ্ধময় পরিস্থিতি কখনই কোন দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। যুদ্ধরত দেশগুলো যেমন অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সেই সঙ্গে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও মুখ থুবড়ে পড়ে।

গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের প্রধান হিসেবে তাঁর এই বলিষ্ঠ উচ্চারণ তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যেও নতুন আশার সঞ্চার করছে। করোনা মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিকে যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নিষেধাজ্ঞা নিষেধাজ্ঞা খেলার যে ভ-ামি তা এখন সবার সামনে স্পষ্ট। এই নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করার সামর্থ্য শুধু দুর্বল দেশগুলোর নেই। অথচ ভ- পশ্চিমা বিশ্ব গোপনে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের লেনদেন অব্যাহত রেখেছে।

রাশিয়ার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছোট বড় মিলে ১০০০০-এর ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। জ্বালানি সঙ্কটের বিষয় আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ আরও একটি বড় সঙ্কট মোকাবেলা করছে। তা হচ্ছে সারের সঙ্কট। বাংলাদেশে রাসায়নিক সারের অন্যতম সরবরাহকারী হচ্ছে রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে সার আমদানি করতে পারছে না। যার দরুন দেশে রাসায়নিক সারের দাম নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় সরকারের কৃষি খাতের জন্য বিশেষ ভর্তুকি কৃষি খাতকে স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখছে।
উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান চায়। একটি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং সামাজিক সম্প্রীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপির হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। বিগত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০.৫ শতাংশে নামাতে সক্ষম হয়েছে সরকার।

এদেশের মাথাপিছু আয় মাত্র এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২,৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পূর্বে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক এক পাঁচ শতাংশ। এর আগে, টানা তিন বছর ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। মহামারী চলাকালেও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬ দশমিক নয় চার শতাংশ হারে প্রসারিত হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত এবং জ্বালানি, খাদ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে আমাদের মতো অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছি।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার জন্য এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু-সহিষ্ণু বদ্বীপে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। এই উন্নয়ন পরিস্থিতি অব্যাহত রাখার জন্য দরকার শান্তিময় বিশ্ব।
যুদ্ধ কখনই কোন পরিস্থিতির সমাধান হতে পারে না, বরং যুদ্ধ সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করে। অতীতের বিভিন্ন উদাহরণ থেকে বিষয়টা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। জার্মানি কর্তৃক অস্ট্রিয়া আক্রমণ সূচনা করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, যা পুরো বিশ্বকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। যুদ্ধ কখনই কোন সুফল বয়ে আনে না। যুদ্ধ করে কেউ কখনও শান্তির পুরস্কার অর্জন করেনি। যুদ্ধ করে কারও নাম ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয়নি। সুতরাং যুদ্ধ শুধু আনে ধ্বংস আর মৃত্যু।

আনে হাহাকার আর দারিদ্র্য। যুদ্ধে যে দেশ নিজেকে বিজয়ী বলে ঘোষণা দেয়, প্রকৃতপক্ষে সে বিজয় দেশটির কোন স্থায়ী সাফল্য এনে দেয় না। আপাতত বীরত্বের খেতাবে ভূষিত হলেও বৃহত্তর অর্থে সেটা তার ক্ষতির কারণই হয়। তাই যুদ্ধ এড়িয়ে দু’পক্ষের বিরাজমান সমস্যাগুলো কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান করাই বুদ্ধিমানদের কাজ বলে মনে হয়। দীর্ঘদিনের করোনাকাল কাটিয়ে সকলে যখন নির্মল পৃথিবীতে প্রাণোচ্ছল জীবনের কথা ভাবছি, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন আরেকটি মহামারীর দিকে ধাবিত করছে বিশ্বকে। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে তেল-গ্যাসের বাজারে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিক এটা আমরা কখনই চাই না। সেই দৃপ্ত উচ্চারণই ফুটে উঠেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন সামনে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা যে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়তে পারি সেই সম্পর্কে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ তার সামর্থ্য অনুযায়ী যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লান’।

‘ক্লাইমেট ভালনেরাবল ফোরাম’ এর সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশের ভূমিকা ইতোমধ্যেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সংগঠিত হয়েছে উন্নত দেশগুলোর জলবায়ুকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার বিরুদ্ধে। আমাদের যুদ্ধ হওয়া উচিত এখন অশুভের বিরুদ্ধে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে, সেই যুদ্ধে একে অপরের বিরাগভাজন না হয়ে একে অপরের সহযোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা পালন সর্বাপেক্ষা জরুরী।
শান্তির পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা বাংলাদেশের কর্মকা-ের মাধ্যমেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সময়ের আচরণে বাংলাদেশ যথেষ্ট ধৈর্য ও কূটনৈতিক প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্তে যেরূপ আচরণ করছে তা নিঃসন্দেহে এদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি এক ধরনের অশ্রদ্ধা প্রদর্শন। ১৯৭৮ সালেও তারা এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, যার সমুচিত জবাবও তারা পেয়েছে। তবে এবার বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে একটি পরিপক্ব দেশের পরিচয় দিচ্ছে। বাংলাদেশ সব রকম সহিংসতার পথ এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকেই বেশি জোর দিচ্ছে।

বর্তমান সরকারের শান্তির পক্ষে এরূপ অবস্থান সত্যিই প্রশংসার যোগ্য, যা বহির্বিশ্বে একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করবে। যুদ্ধ যে কখনই সমাধান হতে পারে না তা ইউরোপীয় দেশগুলো খুব ভালভাবেই টের পাচ্ছে। শীতকাল যত সন্নিকটে আসছে, বসতবাড়ি গরম রাখার মতো জ্বালানি নিয়ে ইউরোপ সাধারণ জনগণের দুশ্চিন্তা আরও প্রবল হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই, গত ৪০ বছরের ইতিহাসে আমেরিকায় এত বড় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়নি, যা কমিয়ে দিয়েছে জনগণের আর্থিক ক্রয়ক্ষমতাকে। বলতে গেলে একটি যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে প্রতিটি দেশের সাধারণ জনগণকে, যাদের এই যুদ্ধের পেছনে কোন স্বার্থই জড়িত নেই।

এই বিষয়টি যে মানবাধিকারের বড় ধরনের লঙ্ঘন তা বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানবাধিকার নিয়ে যারা দিন রাত বুলি আওড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি দেশের চলমান অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের এহেন ভূমিকার বিরুদ্ধেও আমাদের সোচ্চার থাকা উচিত। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে গেছেন, তা এখনও অনুসরণ করা হচ্ছে এই দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে। আশা রাখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্ব মোড়লরা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের খেলা বন্ধ করে বিভিন্ন দেশের জনগণের বৃহৎ স্বার্থের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে।

লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×