ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

অদম্য শেখ কামাল

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৫২, ৪ আগস্ট ২০২২

অদম্য শেখ কামাল

শেখ কামাল

ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক হিসেবে ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও মহান সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামাল সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনআমার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে ৬৯-এর অগ্নিঝরা গণআন্দোলনের স্মৃতিযে আন্দোলনে শেখ কামালের প্রতিদিনের উপস্থিতি ছিল সকলের জন্য তুমুল উসাহব্যঞ্জকএই আন্দোলনে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংগঠিত করে মিছিলসহ বটতলায় সমবেত হতেন তিনিআমার পরম স্নেহভাজন ছিলেন শেখ কামাল

মনে পড়ে ৬৯-এ পাকিস্তান সামরিক জান্তা সরকার ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেশেখ কামাল তখন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীদের সংগঠিত করেন এবং রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসিগানটি খ্যাতিমান শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দিয়ে বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানে গাওয়ানোর উদ্যোগ নেনবাঙালী জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার সন্তান তিনিজন্ম থেকেই তার ধমনীতে নেতৃত্ব গুণ আর বাঙালী জাতীয়তাবোধের চেতনাসংস্কৃতিবান শেখ কামালের প্রতিবাদের ভাষা ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীতবিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই বিশ্বকবির গান গেয়ে অহিংস প্রতিবাদের অসাধারণ উদাহরণ রেখেছেন

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করে হাতিয়ার তুলে নিয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনিপ্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি ছিলেন শেখ কামালমুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে সংগঠিত করেনমুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার আশাবাদ ছিল দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের ছবিটাই পাল্টে দেবেন এবং দেশকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করবেনমুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশ পুনর্গঠনে নিজের অসামান্য মেধা ও অক্লান্ত কর্মক্ষমতা নিয়ে জাতির পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন শেখ কামাল

মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যানসেখান থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেনস্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে শেখ কামালের অবদান অনস্বীকার্যতিনি ছায়ানট থেকে সেতার শিক্ষার তালিম নেনপড়াশোনা, সঙ্গীতচর্চা, অভিনয়, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা থেকে শুরু করে বাংলা ও বাঙালীর সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার চেষ্টায় সদাসর্বদা নিয়োজিত ছিলেন শেখ কামালঅধ্যয়নের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিম-ল তার পদচারণায় ছিল মুখর

স্বাধীনতার পর শেখ কামাল তার বন্ধুদের সহযোগে প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারএবং আধুনিক সঙ্গীত সংগঠন স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে তিনি ছিলেন সুপরিচিত সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া  সংগঠক এবং অভিনেতাআবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দেশের ক্রীড়াজগতে স্মরণীয় হয়ে আছেনস্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাও তাকে অমরত্ব দান করেছেপ্রকৃতপক্ষে শেখ কামাল ছিলেন একজন ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনা সুকুমার মনোবৃত্তির মানুষতিনি কখনও ব্যবসায়িক কার্যকলাপে জড়িত হননিঅনর্থক ছোটেননি অর্থের পেছনে

শাহীন স্কুলের ছাত্র থাকাকালে স্কুলের প্রতিটি খেলায় তিনি ছিলেন অপরিহার্যএর মধ্যে ক্রিকেট ছিল তার প্রিয়কালে অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেন তিনিআজাদ বয়েজ ক্লাবতখন কামালদের মতো উঠতি প্রতিভাদের আশ্রয়স্থলএখানেই শেখ কামাল প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন দীর্ঘদিনদেশ স্বাধীনের পর ৭২-এ আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থাপ্রতিষ্ঠা করেন

এই সংস্থার নামে সংগঠিত করেন ফুটবল দল ইকবাল স্পোর্টিং’, আর ক্রিকেট, হকির দল ইস্পাহানী স্পোর্টিংপরে এসব দলের সমবায়ে নবোদ্যমে যাত্রা শুরু করে আবাহনী ক্রীড়াচক্রফুটবল, ক্রিকেট, হকি এই খেলাগুলোতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল কামালেরতার স্বপ্ন ছিল একদিন আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশ হবে অপরাজেয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রীড়াশক্তিসত্যিই তিনি বেঁচে থাকলে সেটা সম্ভব ছিল

স্বপ্ন তার দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছিল বহুদূর অবধিফুটবলের উন্নতির জন্য ৭৩-এ আবাহনীতে বিদেশী কোচ বিল হার্টকে নিযুক্ত করেনযোগ্যতা, দক্ষতা আর দেশপ্রেমের অসামান্য স্ফুরণে শেখ কামাল অল্পদিনেই বদলে দিয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন একটা দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রশুধু ক্রীড়াই নয়, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সব শাখাতেই ছিল তার মুন্সিয়ানা ও অসামান্য সংগঠকের ভূমিকা

শেখ কামালের নবপরিণীতা বধূ সুলতানা খুকু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদেশজোড়া খ্যাতি ছিল তারআন্তর্জাতিক পরিম-লে তার পরিচিতি ছিল এক প্রতিভাবান এ্যাথলেট হিসেবেনিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন৭৫-এর ১৪ জুলাই যেদিন গণভবনে শেখ কামাল ও শেখ জামাল দুই ভাইয়ের বিয়ে হয় সেদিন আমি সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি

কেননা ওই বছরের ১১ জুলাই আমার বড় ভাই পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) মৃত্যুবরণ করেনআমি তখন ভোলায়বিয়ের দিন ভোলার পুলিশ স্টেশনে ফোন করে বঙ্গবন্ধু আমার খবর নিয়েছিলেনবলেছিলেন, ‘জামাল-কামালের বিয়ের আসরে সকলেই আছেশুধু তুই নাইকত বড় মহান নেতা যে আমার মতো ক্ষুদ্র কর্মীর কথাও সেদিন তিনি ভোলেননি

বিয়ের অল্প কিছুদিন পর ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এ সেনাবাহিনীর কতিপয় বিশ্বাসঘাতক উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের হাতে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাতা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও নববিবাহিতা দুই বধূ, দুই ভাই শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নির্মম মৃত্যুকে বরণ করতে হয় তাকে

জাতির পিতা জীবনের যৌবনের বারোটি বছর কাটিয়েছেন কারান্তরালেতাঁর অনুপস্থিতিতে শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যগণ কখনই কোন খেদোক্তি প্রকাশ করেননিবরং পরিবারের সদস্যরা সেসব সগৌরবে মেনে নিয়ে বাঙালীর জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অংশে পরিণত হয়েছেনদুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, দেশ স্বাধীনের পর কুচক্রী মহল শেখ কামালের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বানোয়াট অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করেছিলযা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং বাস্তবে আদৌ টেকেনি

পরিশেষে কামালের শৈশবের একটি স্মৃতি উদ্ধৃত করছিযে স্মৃতিকথাটি পাঠ করলে দুচোখ পানিতে ভরে আসে, অশ্রু সংবরণ দুঃসাধ্য হয়প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেখ মুজিব আমার পিতাশিরোনামের লেখায় এই স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করেছেন১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেফতার হনআমি তখন খুবই ছোট্ট আর আমার ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছেআব্বা ওকে দেখারও সুযোগ পাননি

একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দী ছিলেনসে সময় আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেনএকবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়কামাল তখন অল্প কথা বলা শিখেছেকিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও নাআমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি আব্বা-আব্বা বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেগোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠওই মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম

আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতামঅনেক ফুল, পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছিও হঠা আমাকে জিজ্ঞাসা করল হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলিকামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে আমি তখন চোখের পানি রাখতে পারি না” 

ঘাতক দলের বুলেট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলঘাতকেরা চেয়েছিল বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করতেতারা জানত জাতির পিতার সন্তানরা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারক-বাহকসেজন্য তারা শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল কাউকেই রেহাই দেয়নি

সেদিন জাতির পিতার দুই কন্যা বিদেশে থাকায় ঘাতকের বুলেট তাদের স্পর্শ করতে পারেনিইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকা-ের পর ৮১তে আমরা দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার হাতে শহীদের রক্তে ভেজা দলীয় পতাকা তুলে দেইসেই পতাকা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে হাতে তুলে নিয়ে জাতির পিতার আদর্শ সমুন্নত রেখে তিনি আজ দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেনবাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করার যে স্বপ্ন শেখ কামাল দেখতেন সেই অসমাপ্ত কাজটিও তারই পৃষ্ঠপোষকতায় সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে চলেছেন

 

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি,

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

[email protected]

 

×