
.
২১ জুলাই ২০২২ আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপের আওতায় দেশব্যাপী ভূমি-গৃহহীনদের ২৬ হাজার ২২৯টি ঘরসহ জমি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি নাগরিকের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করাই দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব বলে মতামত ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘মানুষকে আমি মানুষ হিসেবেই দেখি এবং প্রত্যেকটি মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচবে সেটাই আমি চাই। আমার বাবার সেটাই শিক্ষা। যে কারণে এদেশের প্রত্যেকটি মানুষের সুন্দর জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা আমি করে দিয়ে যেতে চাই। দল-মতের ভিন্নতা থাকতে পারে তাতে কিছু আসে যায় না। দেশটা তো আমাদের। আর আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তার মানে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব আমার। কারও কাছে যদি খবর থাকে বাংলাদেশের একটি মানুষ ভূমিহীন বা গৃহহীন রয়েছে অবশ্যই আমাদের খবর দেবেন। দল-মত নির্বিশেষে যেই গৃহহীন থাকবে তাদেরকেই ঘর করে দেব, ঠিকানা এবং জীবিকার ব্যবস্থা করে দেব।’ উক্ত অনুষ্ঠানে তিনি পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সব উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত উপজেলা হিসেবে ঘোষণা দেন এবং ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলার প্রতিটি উপজেলাকেই এভাবে ভূমি-গৃহহীনমুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, মানুষের মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় নাগরিক স্বাধীনতা অপরিহার্য। জাতিরাষ্ট্রের সকল জনগণের সামগ্রিক সুযোগ-সুবিধা অবারিত ভোগ করার মধ্যেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বহির্প্রকাশ। আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় মুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার প্রয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল করে সমাজের স্বয়ম্ভরতা অর্জনে মানুষ তার মুক্তচিন্তার অবাধ প্রকাশ ও সাংস্কৃতিক বিবেককে জাগ্রত করা একান্ত প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে। এর ধারাবাহিকতাই একুশ শতক ছিল সবচেয়ে সৃষ্টিশীল শতক যা বিশ্বের প্রায় সকল মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে স্পন্দিত এবং তা অর্জনে প্রচন্ড শক্তি জুগিয়েছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক মনীষী এরিস্টটল বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বস্তুবাদী দর্শনের ঐতিহ্যিক মাত্রায় শুধু জীবনের প্রয়োজনে নয়, বরং উত্তম জীবন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিকে সর্বোৎকৃষ্ট জীবনের দিকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে মানুষ সকল সামাজিক সম্পর্ক এবং শক্তির বন্ধনে জাগতিক ও সামষ্টিক প্রয়োজনে রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত করেছে।
এজন্যই রাষ্ট্র মানুষের পরিপূর্ণ জীবনপ্রবাহের গতিময়তায় একটি অনিবার্য প্রতিষ্ঠানরূপেই প্রতিভাত। মানবসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ বা পরিবার ও সমাজের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সার্থকতা সর্বজনবিদিত। ব্যক্তি-শ্রেণী বা দলীয় স্বার্থ রক্ষার যে ধারণা তথা স্বৈরতন্ত্র-অভিজাতন্ত্রের বিপরীতে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে জনন্যায়তন্ত্র বা গণতন্ত্র। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার যে বিশ্বজনীন ধারণা ও চেতনা ইউরোপে রেনেসাঁ বা ফরাসী বিপ্লবের মতো অন্যান্য বিপ্লবের পেছনে কাজ করেছে পরবর্তীতে সে শক্তিই গণতন্ত্রের সোপান রচনায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্র প্রায় সকল ক্ষেত্রে জনগণের চরিত্র, আশা-আকাক্সক্ষা, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়সমূহ মূল্যায়নে মুক্ত সমাজ গঠন প্রক্রিয়াকে সুস্পষ্ট করেছে। এটিই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ইতিহাসের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য।
গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অর্থাৎ ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতার তথা চিন্তা-বাক-সংগঠনের স্বাধীনতা, ভোট দান, দলগঠন এবং অংশগ্রহণ, প্রার্থী হওয়া-নির্বাচনে অংশগ্রহণ-ভোট দেয়া-অভিযোগ স্থাপনের স্বাধীনতা অর্থাৎ সার্বিকভাবে জীবনধারণ-পরিবার গঠন-নিরাপত্তা বিধান-আইনের আশ্রয়-স্বাধীন মতামত প্রকাশ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বিরোধিতার অধিকার ইত্যাদি সকল কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্ব বিকাশের সঙ্গে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে সাদরে গ্রহণ করার মন-মানসিকতা। যে কোন সামাজিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ একমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশেই সম্ভব। এজন্যই বিশ্বের সকল সভ্য দেশ, বিবেকবান-মানবতাবাদী মানুষ গণতন্ত্রের ভাবধারায় বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক শিক্ষাই হচ্ছে নিজের ইচ্ছার সঙ্গে অন্যের ইচ্ছার সমন্বয় ঘটানো বা অধিকাংশের ইচ্ছা বা আগ্রহকে যৌক্তিকভাবে নিজের বা ব্যক্তির অধিকারে সন্নিবেশন। ভল্টেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) বলেছেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব।’
আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটন তার প্রসিদ্ধ ‘দ্য থার্ড ওয়েভ : ডেমোক্রেটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’ বইয়ে আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের তিনটি পর্বের উল্লেখ করেছেন। ১৮২৮ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্বে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ২৯টি দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। ১৯২০ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত আবার কোথাও ফ্যাসিজম ও কমিউনিজমের বিকাশ পরিলক্ষিত হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যৌথবাহিনীর বিজয়ের পর থেকে। তখন বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬টিতে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্রের নিম্নগামীর সময় প্রভাব বিস্তার করে কমিউনিস্ট শাসিত সমাজতান্ত্রিক সরকার। বিশ্বে গণতান্ত্রিক ধারার শেষ পর্বটি হচ্ছে ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। উক্ত সময়ে দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্র প্রসারিত হয়ে ১৯৯৪ সাল নাগাদ গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা হয় ৭২টি।
আমাদের সকলের জানা যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। আর সমাজতন্ত্র বিস্তৃতির জন্য কাজ করছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রকে সুসংহত করার লক্ষ্যে পশ্চিমা বিশ্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে ঋণ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। ফলে অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর দেশগুলো পুনর্গঠনে সুযোগ লাভ করে এবং গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু করতে সক্ষম হয়। যা বর্তমানে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। পক্ষান্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের প্রসার হলেও অর্থনৈতিক মন্দা-সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে খুববেশি বিস্তৃত হতে পারেনি। যেটি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্তিমিত হতে থাকে। ফলে এককভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রোল মডেল। যদিও বিশ্বে এখনও ভিয়েতনাম, কিউবা, চীন, উত্তর কোরিয়াসহ অনেক দেশে কমিউনিস্ট শাসিত সরকার নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমা বিশ্বে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূলে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান অনিস্বীকার্য।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্বে অদ্যাবধি অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে ইরানে প্রথমবারের মতো সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলেও পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ায় তা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৯৫৩ সালে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত হওয়ার পর থেকে ১৯৮৯ সালের বিপ্লব পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ইরানে গণতান্ত্রিক চর্চা রুদ্ধ ছিল। ১৯৬৮ সালে ইরাকে সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ২০০৩ সালে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর অযাচিত অভিযোগ ও গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কিন্তু ২০০৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইরাকে গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়নি। উপরন্তু আবির্ভাব ঘটেছে ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গী সংগঠনের। দীর্ঘ তিন দশক ধরে ক্ষমতাসীন হোসনি মোবারকের শাসনামলে মিসরে কিছুটা গণতন্ত্রের আলোক প্রজ্বলিত হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি গণতন্ত্র। ২০১২ সালে দেশটিতে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত। ২০১৩ সালে ক্যু-অভ্যুত্থানের ফলে পুনরায় মিসরের গণতান্ত্রিক পথচলায় প্রতিবন্ধকতা সূচিত হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনায় বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল। একবিংশ শতাব্দীতে সেটি অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর অনেক দেশে গণতন্ত্র নামমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিশ্বজুড়ে মার খাচ্ছে গণতন্ত্র। আধুনিক গণতন্ত্রের ধারক-বাহক দেশগুলোতেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ নড়বড়ে। পূর্বে যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও নির্বাচিত নেতার সংখ্যা বেশি হলেও সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা অনেকাংশে কম। ২০১৯ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসিস ইনস্টিটিউটের (ডি-ডেম) প্রতিবেদনে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১৭৯টি দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থা পর্যালোচনায় প্রস্তুতকৃত এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গত শতাব্দীতে উদারবাদী গণতন্ত্রের চর্চা বাড়লেও একুশ শতকে এসে তা ব্যাপক হারে কমেছে। প্রতিবেদনের এক সূচকে দেখা যায়, ১০ বছরে ১৭৯টি দেশের মধ্যে ১৫৮টি দেশে সামগ্রিক গণতান্ত্রিক অবস্থার উন্নতি হয়নি অথবা অবনতি ঘটেছে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিলসহ ২৪টি দেশ। যাদের গণতন্ত্র চর্চায় ব্যাপক অবনতি পরিলক্ষিত। প্রকৃত অর্থে এই দেশগুলো কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকছে। বিশ্বে কর্তৃত্ববাদের জোয়ার চলছে বলেও সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে ফুটে উঠেছে।
উল্লেখিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এখনও গণতন্ত্রের ভবিষ্যত শেষ হয়ে যায়নি। দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকা দেশগুলোতে ওই ব্যবস্থা নিয়ে আস্থা কিছুটা কমলেও ছোট দেশগুলোতে আস্থা বেড়েছে। গত এক দশকে ২১টি দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার উন্নতি হয়েছে। তিউনিসিয়া, গাম্বিয়া, শ্রীলঙ্কা, ফিজিসহ সাত দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে। হংকংও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে। গণতান্ত্রিক চর্চার দাবিতে ইরান, লেবানন, ইরাকেও বিক্ষোভ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী অর্থায়নে পরিচালিত ওয়াশিংটনভিত্তিক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজের তথ্য-উপাত্তেও বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবনতির বিষয়টি চিত্রিত হয়েছে। সংস্থাটির মতানুসারে টানা ১৩ বছর ধরে গণতন্ত্রের চর্চা নিম্নমুখী। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হোভার ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো লরি ডায়মন্ডের ভাষ্য মতে, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার আগ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় শুরু হয়। বিশ্বায়ন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়ানো, প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি এই অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করেছে। তবে চলতি দশক গণতন্ত্রের জন্য খুবই খারাপ সময়। আগের শতাব্দীর চেয়ে বর্তমান শতাব্দীতে গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি শক্তিমান।’
মুক্তির মহানায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রণিধানযোগ্য উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য-বৈষম্য-শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। একীভূত অভিধায় যা সোনার বাংলা নামক জাতিরাষ্ট্রের আবির্ভাবকে জনগণের হৃদয়গভীরে প্রগাঢ় প্রাণস্পন্দন সঞ্চারিত করেছে। প্রাণ বিসর্জনের মতো সংগ্রামী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এতদ অঞ্চলের বঞ্চিত মানুষগুলো মুক্ত মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠায় এতটুুকু পিছপা হয়নি। দেশপ্রেম-সত্যের কাঠিন্যে অবিচল বঙ্গবন্ধু ন্যূনতম নতিস্বীকার না করে আপোসহীন কিংবদন্তি নেতৃত্বের মোড়কে শুধু স্বাধীন দেশ উপহার দেননি; স্বাধীনতাকে অর্থবহ করা-অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিটি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশ পুনর্গঠনে একনিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ-মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধ-সমৃদ্ধ জীবন গঠনের নন্দিত দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ও পরিচালিত কর্মযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় তাঁর সুযোগ্য তনয়া দেশ পরিচালনায় অসাধারণ সাফল্য-সার্থকতা অর্জনে আজ বিশ্ব সমাদৃত।
প্রকৃত অর্থে তিনি দীর্ঘকাল সেনা-স্বৈরশাসিত কদর্য অন্তরায় সমূহকে নস্যাৎ করে দেশকে নবতর পর্যায়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আচ্ছাদনে সরকার পরিচালনা করে যাচ্ছেন। দল-মত নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ যাতে উপকৃত হয় ও সকল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উর্ধে দেশের স্বার্থ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালনে দেশরত্ন শেখ হাসিনার আহ্বান সত্যিকার গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের অনবদ্য পরিচায়ক। দলভিত্তিক প্রতিযোগিতায় জনগণ কর্তৃক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর দেশ পরিচালনায় কোন দলীয় পরিচয় থাকা অনাকাক্সিক্ষত-অনভিপ্রেত। পবিত্র সংবিধান সমুন্নত রেখে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়-অঙ্গ সংস্থাসমূহ সমগ্র জনগণেরই মঙ্গল সাধনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা বিশেষ দলের স্বার্থ রক্ষা নয়, সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপই হবে পুরো জাতির নন্দিত প্রেক্ষাপট। মোদ্দাকথা দল-মত যার যার প্রধানমন্ত্রী-সরকার সবার। উল্লেখ্য, আত্মবিশ্বাসটুকু অত্যুজ্জ্বল করার মাধ্যমে যে কোন কিছুর বিনিময়ে গণতন্ত্র অপরাজিত থাকুক- বিনয়ের সঙ্গে এই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়