ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শিক্ষকের মর্যাদা

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২১:৩২, ২১ জুলাই ২০২২

শিক্ষকের মর্যাদা

.

শিক্ষক হলেন জাতির আলোক বর্তিকাবাহী এবং মানবজাতির ভবিষ্যতের রূপকারশিক্ষকতা হলো এমন একটি পেশা যা অন্যান্য পেশার সৃষ্টি করেতাই তো হেনরি এডামস বলেছেন, একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলে, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়একজন শিক্ষকের ভূমিকা ব্যতীত কোন জাতিই শিক্ষিত জাতিতে পরিণত হতে পারে নাশিক্ষার হাতে-খড়ি যদিও শুরু হয় পরিবার থেকে, কিন্তু তার পূর্ণতা পায় একজন শিক্ষকের হাতেজাপানী একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে, এক হাজার দিনের পরিশ্রমী অধ্যয়নের চেয়ে একদিন একজন শিক্ষকের কাছে অধ্যয়ন করা অধিক শ্রেয়একটি শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রতিটি পদক্ষেপে শিক্ষকের গুরুত্ব লক্ষণীয়সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে মুখ্যভূমিকা পালন করেনতাই তো শিক্ষককে বলা হয় সন্তানের দ্বিতীয় জন্মদাতা

যুগে যুগে, কালে কালে স্মরণীয়, নমস্য ব্যক্তিরাও তাদের শিক্ষকদের প্রতি সবিনীত শ্রদ্ধাশীল থাকতে পিছ পা হননিইমাম আযম আবু হানিফা (রাহঃ) যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন আমি তার বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনিআমার মনে হতো, এতে যদি তার শিক্ষকের প্রতি আমার অসম্মান হয়ে যায়জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষককে মর্যাদা দানের বিষয়ে ছিলেন সদা সচেতনবঙ্গবন্ধু তাঁর মানবতাবাদী মানস চিত্তে সবাইকে ধারণ ও লালন করতেন; এখানেই তাঁর সঙ্গে অন্যদের পার্থক্যমহান আদর্শ ও উদার নৈতিক দর্শনও এখানেই নিহিত রয়েছেশিক্ষকের প্রতি অগাধ আনুগত্যের নমুনা তাঁর জীবনাচরণ পর্যালোচনা করলে পাওয়া যায়শিক্ষক সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল অপরিসীমতিনি শিক্ষকদের সম্মান করতেন, শ্রদ্ধা করতেন এবং শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষায় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণএ বিষয়ে কয়েকটি ঘটনা প্রবাহ উল্লেখ করা যেতে পারে-

প্রথমত, ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে দেশে ফিরে এসেছেন বঙ্গবন্ধুসদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের পর্বতময় সমস্যা মোকাবেলায় রাত দিন পরিশ্রম করছেন বঙ্গবন্ধুএমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা ছাড়াই ডিগ্রী প্রদানের জন্য আন্দোলন শুরু করলপরীক্ষার্থীদের দাবি ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তারা লেখাপড়া করতে পারেনি, এমনকি যুদ্ধ শেষে দেশে তারা বই খাতা ও নোটপত্রও খুঁজে পাচ্ছে নাআন্দোলনরত পরীক্ষার্থীদের দাবিও কিছুটা যুক্তিযুক্ততবে পরীক্ষা ছাড়া ডিগ্রী প্রদান করলে দেশ-বিদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা দারুণভাবে ক্ষুণœ হবে বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার্থীদের এ দাবি সরাসরি নাকচ করে দেনকিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায়ের প্রশ্নে অনড় অবস্থান গ্রহণ করে এবং প্রচন্ড আন্দোলন শুরু করেএ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী ছাত্রদের দাবির কাছে কোনভাবেই নতিস্বীকার করতে রাজি হলেন নাপরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সামগ্রিক বিষয়টি আলোচনার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বান করেনএকাডেমিক কাউন্সিলের প্রায় সকল সদস্যই ছাত্রদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বক্তব্য রাখেনএ খবর জানতে পেরে দাবি আদায়ে মরিয়া ছাত্ররা একাডেমিক কাউন্সিলের সভাকক্ষ অবরোধ করেশুধু তাই নয় ছাত্ররা সভাকক্ষের পানি ও বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়অন্ধকারাচ্ছন্ন সভাকক্ষের পরিবেশ ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে ওঠেঅধ্যাপক মোকারম হোসেন খন্দকারসহ কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক সভাকক্ষে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন

উপর্যুক্ত অবস্থা চলাকালে তকালীন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের এক জরুরী সভা চলছিলঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ছাত্রদের দ্বারা অবরুদ্ধ আছেন এমন সংবাদ পেয়ে তিনি খুবই বিচলিত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের সভা স্থগিত করে তিনি ছুটে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের সভাকক্ষেবঙ্গন্ধুর গাড়ি আসছে দেখতে পেয়ে অবরোধকারী ছাত্ররা দ্রুত পালিয়ে যায়বঙ্গবন্ধু অবরুদ্ধ কাউন্সিল কক্ষে প্রবেশ করেন এবং অবরুদ্ধ শিক্ষকদের উদ্ধার করেনঅতঃপর তিনি শিক্ষকদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন এবং ছাত্রদের এই বাড়াবাড়ির জন্য সরকারপ্রধান হিসেবে দুঃখ প্রকাশ করে নিজ দফতরে ফিরে যান

দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হওয়ার পর অধ্যাপক আবুল ফজল শেখ মুজিবকে যেমন দেখেছিশীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেনশিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগাধ শ্রদ্ধার কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক আবুল ফজল লিখেছেন ৬৯-এর নবেম্বর মাসে ইত্তেফাক পত্রিকায় শক্ত কেন্দ্র কেন ও কার জন্যশিরোনামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন জানিয়ে তাকে পত্র লিখেছিলেনবঙ্গবন্ধুর পত্রের জবাবে অধ্যাপক আবুল ফজল যে পত্র লিখেছিলেন তার উত্তরে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, আপনার মতো জ্ঞানী, গুণী ও দেশপ্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে পারলে খুবই আনন্দিত হতামআবার যখন চট্টগ্রামে যাব, সাহিত্য নিকেতনে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে দেখা করবঅধ্যাপক আবুল ফজলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফোন করে বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক আবুল ফজলের অনুমতি নিয়েছিলেন বলে আবুল ফজল তার লেখায় উল্লেখ করেছেনএই হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনাচারেও শিক্ষকের প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়২০১৯ সালের বইমেলার একটি ঘটনা সবার নজর কেড়েছেপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে লাল গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেনএমন সময় প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষক আনিসুজ্জামানের কাঁধ থেকে অসতর্কতায় পড়ে যায় চাদরসেটি প্রধানমন্ত্রী দেখে নিজেই তাঁর শিক্ষকের কাঁধে চাদরটি গুছিয়ে দিলেন গভীর মমতায়; যেন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন; শিক্ষা গুরুর সান্নিধ্যে বিনয়াবনত এক শিষ্যরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠান করেও প্রকৃত শিক্ষককে মর্যাদা দেয়ার কথা ভোলেননি এক মুহূর্তের জন্যওএকজন শিক্ষককে সম্মান দিতে রাষ্ট্রীয় পদ-পদবি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি সেদিনঅথচ এ প্রজন্মের ছেলেরা কী করছে! তাদের এমন নিন্দনীয় আচরণে আমরা জাতি হিসেবে লজ্জিতশিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্কের টানাপোড়েন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে

ছাত্রদের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে অহরহবর্তমান সময়ে শিক্ষকদের যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছেশিক্ষক শুধু ছাত্র সমাজের কাছেই সম্মানের পাত্র নয়, সেই সঙ্গে প্রতিটি শ্রেণীর মানুষের কাছেই শিক্ষকের মর্যাদা হওয়া উচিত সর্বোচ্চএকজন শিক্ষকের বলিষ্ঠ পদক্ষেপে একজন ছাত্র পায় তার কর্ম পথের দিকনির্দেশনা, সেই সঙ্গে জাগ্রত হয় তার নৈতিক বিচার, বুদ্ধি ও বিবেকপ্রতিটি ছাত্রের জীবন গড়ার পিছনে একজন শিক্ষকের থাকে বৃহ প্রচেষ্টা ও ত্যাগএমন একটি আত্মত্যাগের উকৃষ্ট উদাহরণ শহীদ ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহারাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালনকালে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন তিনিপ্রত্যেকটি শিক্ষকের এমন ত্যাগের মহিমা যখন ছাত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হবে, তখন জাতির প্রতি তার দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাবেযে সমাজে শিক্ষকের সম্মান, মর্যাদা হরণ হয়, সে সমাজ আর যাই হোক উন্নত সমাজে পরিণত হতে পারে নাসে জাতি দিনে দিনে অজ্ঞাত ও অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই

নৈতিক গুণাবলী অর্জনের প্রাথমিক মাধ্যম হলো পরিবারপ্রতিটি বাবা-মাকে তার সন্তানের প্রতি হতে হবে যতœশীল ও সচেতননৈতিকতাও অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শিক্ষণের সূত্রপাত ঘটে পরিবার থেকেরাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার বিষয়গুলো আমলে এনে যথোপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত

লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

×