ইসলামের ইতিহাসে বহুল আলোচিত উহুদ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মহানবী (স.)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হয়েছিল। তখন থেকেই উহুদের প্রান্তর হয়ে ওঠে নবীজির নেক নজরের নিশানা এবং যুগ যুগ ধরে হজ ও জিয়ারতকারীদের আবেগময় দর্শনীয় স্থান। স্মর্তব্য, উহুদ পর্বত সৌদি আরবের মদিনা শহরের উত্তরে অবস্থিত। এর উচ্চতা ১০৭৭ মি. (৩৫৩৩ ফুট)। মক্কার কুরাইশ ও মদিনার মুসলিমদের মধ্যকার উহুদের যুদ্ধ এই পর্বত সংলগ্ন স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। এ রণক্ষেত্রে নবী (স.) এর চাচা হযরত হামজা (রা.) এবং হযরত আকিল ইবনে উমাইয়া (রা.) সহ সত্তরজন সাহাবা শহীদ হয়েছিলেন। হযরত আমির হামজা (রা.) ও আকিল (রা.)কে একই কবরে দাফন করা হয়। পরে উহুদ প্রান্তরে একটি সুদৃশ্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়। রয়েছ হযরত হামজা (রা.) এর নামে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মসজিদের সামনে উহুদ যুদ্ধের শহীদদের কবরস্থান। মূল কবরগুলোকে সামান্য ইট দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
উহুদ প্রান্তরের কবরগুলো পার হয়ে সামনে এগুলে ছোট একটি পাহাড়। এ পাহাড়কে অনেকে রুমা পাহাড় বলে থাকেন। তবে এর আসল নাম জাবালে রুমাত। উহুদ যুদ্ধের সঙ্গে এ পাহাড়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেদিন এ ছোট্ট পাহাড়টিই উভয় পক্ষের ভাগ্য নির্ধারণী ঠিকানায় পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে উহুদ প্রান্তরের মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে রাসূল (স.) এটিকে উপমা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, যে কোন ব্যক্তি কোন মরহুমের জানাজার সালাত আদায় এবং মাটি দেয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করবে সে দুই কিরাত নেকি পাবে আর এক কিরাত হলো পবিত্র উহুদ পাহাড়ের সমান। সাহাবী আনাস ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেছেন: উহুদ এমন একটি পাহাড় যা আমাদের ভালবাসে এবং আমরাও তাকে ভালবাসি।
৬২৪ খ্রি./ হিজরী ২য় সনে বদর যুদ্ধে মাত্র তিন শ’ তেরজন মুসলমানের এক ক্ষুদ্র বাহিনীর হাতে বিরাট কাফিরচক্রের পরাজয়ের পর মক্কায় ইসলামবিদ্বেষী কুরাইশরা প্রতিশোধের স্পৃহায় দগ্ধিভূত হয়ে এ অভিযানের সূত্রপাত ঘটায়। এ যুদ্ধ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সুরা আল ইমরানে আল্লাহ তায়ালা অনেক কিছু বলেছেন। এ যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনীকে নেতার আনুগত্যের কথা ভুলে যাওয়ায় চরম মূল্য দিতে হয়। ঈমানের এক জ্বলন্ত অগ্নিপরীক্ষা ও প্রতীকী দৃষ্টান্ত ছিল উহুদ যুদ্ধ। ঘটনাটি ছিল এমন : তিন হাজার উট এবং দু’শত অশ্বসজ্জিত হয়ে মক্কার কাফির সর্দার আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশ বাহিনী মুসলমানদের আঘাত হানার জন্য ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে/৩য় হিজরীতে মদিনার দিকে যাত্রা করে। ২১মার্চ মদিনার উপকণ্ঠে উহুদ পর্বতের পাদদেশে তারা শিবির স্থাপন করে। এ সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (স.) মজলিশে শূরার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তানুযায়ী হাজারখানেক মুসলিম সৈন্য নিয়ে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে উহুদের দিকে রওনা হন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনশ’ সৈন্য নিয়ে মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাঈ গা ঢাকা দেয়। ফলে মুসলিম সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় সাতশ’তে। এ দিনে উভয় পক্ষ মল্লযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। শুরুতেই ইসলাম বিদ্বেষী কুরাইশদের বিপর্যয়। একে একে ধরাশায়ী হলো তাদের ক’জন বীর। পুরো ময়দান মুসলিম বাহিনীর অনুকূলে। কিন্তু এ সময়ই ঘটে গেল এক দুঃখজনক বিপর্যয়। যুদ্ধ শুরুর আগে মহান সমরনায়ক মহানবী (স.) উহুদ পাহাড়ের অনতিদূরে রুমাত পাহাড়টি ঘিরে একটি প্রবেশ পথে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজকে স্থান পরিত্যাগ না করার আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ, শত্রুবাহিনী উক্ত পথ অবরোধ করলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা ছিল। মুসলমানদের জয় সুনিশ্চিত দেখে তীরন্দাজরা হযরতের আদেশ বিস্মৃত হয়ে শত্রুর মালামাল আহরণের জন্য স্থান পরিত্যাগ করে। মুসলমানদের এ আত্মভোলা অবস্থা দেখে তৎকালীন অমুসলিমদের পক্ষের তুখোড় সেনাধ্যক্ষ খালিদ একদল অশ্বারোহী সৈন্যসহ মুহূর্তের মধ্যে সে অরক্ষিত পথে অতর্কিতে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বয়ং আল্লাহর নবী (স.) শত্রুর হাতে আক্রান্ত হন। পায়ে এবং মুখে আঘাত লাগায় তিনি সংজ্ঞা হারান। তাকে সরিয়ে নেয়া হলো উহুদ পাহাড়ের এক নিরাপদ স্থানে। মরু পাহাড়টির এক বিশেষ অংশ নরম আবরণ ধারণ করে মহানবীর হৃদয় মনে পরম প্রশান্তি বিলাতে থাকে। এদিকে মাঠে ময়দানে হযরতের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে। একদিকে হযরত মুহাম্মদের (স.) মৃত্যু সংবাদ, অপরদিকে খালেদের আক্রমণ। মুসলমানরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল। হযরতের চাচা হামজা অপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহাদাতবরণ করেন। হযরত আবু বকর, ওমর, আলী (রা.) সকলেই আহত হন। উহুদ পর্বতের উচ্চদেশে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর সেবা শুশ্রুষা চলতে থাকে। কুরাইশরাও মুসলমানদের পর্যুদস্ত করতেই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল। মদিনা আক্রমণ কিংবা হযরতের পশ্চাদ্ধাবনের সামর্থ্যও তাদের ছিল না। তারা ফিরে যেতে শুরু করে।
প্রসঙ্গত নবুয়তের ত্রয়োদশ বছরে আরও অনেকের সঙ্গে হযরত হামজাও মদিনায় হিজরত করেন। হিজরী দ্বিতীয় সনে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। হযরত হামজা পাগড়ীর ওপর উটপাখির পালক গুঁজে রেখেছিলেন। এ কারণে যেদিকে তিনি যাচ্ছিলেন সুস্পষ্টভাবে তাকে দেখা যাচ্ছিল। দু’হাতে বজ্রমুষ্টিতে তরবারি ধরে বীরত্বের সঙ্গে কাফিরদের ব্যূহ তছনছ করে দিচ্ছিলেন। এ যুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমনরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। উমাইয়া ইবন খালাফ হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফকে জিজ্ঞেস করেছিল : উটপাখির পালক লাগানো এ লোকটি কে? তিনি যখন বললেন : রাসূলুল্লাহর (সা.) চাচা হামজা, তখন সে বলেছিল : এ ব্যক্তিই আজ আমাদের বেশি সর্বনাশ করেছে। এ কারণে কুরাইশরা তাঁরই খুনের পিয়াসী ছিল বেশি। হযরত হামজার হত্যাকারী ওয়াহশী উহুদ ময়দানে হামজার হত্যার ঘটনাটি পরবর্তীকালে বর্ণনা করেছেন। ওয়াহশী বলেন : আমি ছিলাম জুবাইর ইবন মুতয়িমের এক ক্রীতদাস। বদর যুদ্ধে জুবাইরের চাচা তুয়াইম ইবন আদী হামজার হাতে নিহত হয়। মক্কায় ফিরে জুবাইর আমাকে বলল, যদি তুমি মুহাম্মদের চাচা হামজাকে হত্যা করে আমার চাচার হত্যার বদলা নিতে পার, আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব। আমাকে সে বিশেষভাবে ট্রেনিংও দিল। আমি শুধু হামজাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই উহুদ প্রান্তরে আসি। হযরত হামজার বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি। হযরত হামজার শাহাদাত লাভের পর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতু উতবা হামজার নাক, কান কেটে অলঙ্কার বানিয়েছিল, বুক, পেট চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে উপহাস করেছিল।
হযরত হামজার হত্যাকারী হযরত ওয়াহশী (রা.) মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর (স.) খেদমতে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ওয়াহশী? জবাব দিলেন, হ্যাঁ। তুমিই কি হামজাকে হত্যা করেছো? জবাব দিলেন, আল্লাহর রাসূল যা শুনেছেন, তা সত্য। রাসূল (স.) বললেন, তুমি কি তোমার চেহারা আমার নিকট একটু গোপন করতে পার? তখনই তিনি বাইরে বেরিয়ে যান এবং জীবনে আর কখনো রাসূলুল্লাহর (স.) মুখোমুখি হননি। রাসূলুল্লাহ (স.)-এর ওফাতের পর হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা.) খিলাফতকালে ভন্ড নবী মুসাইলামার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। তিনিও সে অভিযানে অংশ নিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, মুসাইলামাকে হত্যা করে হযরত হামজার হত্যার কাফফারা আদায় করবেন। তিনি সফল হলেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দিয়ে ইসলামের উপকার সাধন করেন। ২৩ মার্চ মতান্তরে ১৫ এপ্রিল ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে উহুদ প্রান্তরে মুসলমান ও মুসলিম বিদ্বেষী কুরাইশদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উহুদের রক্তান্ত প্রান্তর আমাদের জন্য ত্যাগী মনোভাবাপন্ন হওয়ার এক চির উন্মুক্ত অধ্যায়।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]